রবিবার, ২১ জুলাই, ২০১৯

আঁচল ভরা আঁধার


গাজী সাইফুল ইসলাম
There is never a time or place for true love. It happens accidentally, in a heartbeat, in a single flashing, throbbing moment.                           -Sarah Dessen

মিরাজ ও সিরাজ অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার পর পরই ঢাকায় চলে আসে। দু’জনেরই স্বপ্ন কোনো একটা বিষয়ে স্কলারসিপ জুটিয়ে বিদেশ চলে যাবে পড়াশোনা করার জন্য। ঢাকায় তারা ওঠে ১০০ ন¤¦র নয়াটোলায়। তিনতলার একটি রুম ভাড়া নেয় সাবলেট হিসেবে। দুজনেই ভালো ছাত্র। অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইংরেজি সববিষয়ে দক্ষ। দুজনই এক ক্লাসে পড়ার সময় ফাস্ট সেকেন্ড হয়েছে। এখনো সবসময় পড়াশোনা নিয়েই থাকে তারা। কখনো নিজে পড়ে কখনো অন্যকে পড়ায়। তাদের দু’বন্ধুর মধ্যে আবার খুব ভাব। এক বিছানায় পাশাপাশি শোয়। এক রান্নায় খায়। শুক্রবারে জুম্মার নামাজও পড়তে যায় একসঙ্গে। মসজিদে যাওয়ার সময় ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি পরে আতর খুসবু লাগায়। আবার সকালে ব্যায়াম করতেও যায় একসঙ্গেই। ব্যায়াম শেষে গোসল সেরে লেগে যায় রান্নায়। কেউ রাঁধে ভাত, কেউ তরকারী। রান্নায়ও তারা সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। মাছ-মাংস ডাল ঠিক থাকে লবণ ঝাল। কিন্তু ইদানিং সিরাজটা রান্নার ব্যাপারে বড় উদাসীন। ডালে লবণ দেয় তো মরিচ দেয় না। মরিচ দেয় তো আদা-রসুন-জিরা দেয় না। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে প্রায়শই লেগে যাচ্ছে ঝগড়া। 
-আজ তোর মন কোথায় ছিলরে। তরকারিতে লবণ হয়নি কেন? মিরাজ বলে।
-আরে খা খা। একটু লবণ লইলেই তো হয়।
-আমি কাঁচা লবণ খাই না।
-লবণের আবার কাঁচা পাকা কী?
-আছে, তুই বুঝবি না।
-বা! অঙ্ক, ইংরেজি, বিজ্ঞান বুঝি লবণের কাঁচা পাকা বুঝব না ভালোই বলেছিস। এত মাপ মতো লবণ খেতে চাইলে বিয়া কইরা ল।
-বিয়া করলে তোর কী অইব? তুই কই যাইবি।
-যেদিকে দুচোখ যায়। এক দুয়ার বন্ধ হবে তো হাজার দুয়ার খুলে যাবে। এটা হলো ন্যাচারাল থিওরি।
-অত সহজ না। তরে দিয়া কিচ্ছু অইব না। মানুষের বাড়িতে খানসামাগিরি করেও ভাত পাবি না।
-তুই আছিস কেন? তুই খাওয়াবি।
-হ ঠেকছি, তুই আমার বউ আরকি?
-কী বলছেন মিরাজ ভাই, কে আপনার বউ? সহেলি এসে উঁকি দেয়।
সহেলি বাড়িওয়ালার মেয়ে। ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। মাঝারি উচ্চতার, চিপচিপে ল¤¦া গড়নের দেখতে ভারি সুন্দরী সে।  হরদম হাসি খুশি। তার সঙ্গে কথা বলার পর কারও মনে হবে না যে, দুনিয়াতে কোনো দুঃখ যন্ত্রণা আছে।
-ওই সিরাজডা।
-সিরাজ ভাই মিরাজ ভাই কী বলছে এটা?
-ও একটা পাগল কী বলে না বলে।
-আমি পাগল? জানো সহেলি ইদানিং ওর যে কী হয়েছে। কিচ্ছু মনে রাখতে পারে না। আজ ডালে লবণ বেশি তো কাল দেয়ইনি।
সিরাজ মিরাজের মুখ চেপে ধরে। আরে বেক্কেল চুপ চুপ। ঘরের কথা পরের লগে কইতে নাই।
-প্রত্যেকদিনই আমাকে জিজ্ঞেস করতে হয়: ও মনু ডাইলে লবণ দেছ না দেবা?  হালার কিছু মনে থাকে না।
-তাই নাকি?
-তো মন কই থাকে সিরাজ ভাই? সহেলি জিজ্ঞেস করে।
-মন কই থাকে এটা যদি জানতাম তাইলে তো ডাইলেই লবণ দিতাম।
-তাহলে এটা মনের সমস্যা?
-বলতে পারো।
-প্রেমেটেমে পড়েননি তো?
-প্রেমে পড়বে ও? সাহস আছে নাকি? মিরাজ বলে।
-উনার তো খুব সাহস আছে। জীবনে কত প্রেম পড়েছেন।
-তাই নাকি? জানতাম না নাতো।
-আরে পড়লে তো জানবে। ও তো মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেই সাহস পায় না।
-তাই নাকি, এই যে সহেলির সঙ্গে কথা বলছি তোর সামনে।
-সহেলি কি মেয়ে নাকি?
তাদের কথা শুনে সহেলি হেসে ভেঙে পড়ছে।
-তাহলে সহেলি কি ছেলে?
-ও তো আমাদের বন্ধু। বন্ধু আবার ছেলে মেয়ে হয় না কি?
-দারুণ বলেছেন মিরাজ ভাই। বন্ধু কখনো ছেলে মেয়ে হয় না।
-তুই তো গ্রেটম্যানদের মতো কথা বলছিস। শুনেছি প্রেমে পড়লে মানুষ এমন গ্রেটম্যান গ্রেটম্যান ভাব ধরে।
-বা! আপনিও ভালো বলেছেন সিরাজ ভাই। তো আপনিও প্রেমে পড়–ন না। গ্রেটম্যান হয়ে উঠবেন।
-আরে না, ওই লেখক যাযাবর আমার সাহসটা মাটি করে দিয়েছেন।
-‘যাযাবর’এটা আবার কেমন নাম হলো?
-আরে ছদ্ম নাম। আসল নাম ‘চারু চন্দ্র মজুমদার’। একটা বই-ই পাওয়া যায়। ‘দৃষ্টিপাত’। ওই বইটা পড়েই তো মিরাজ প্রথম কবিতায় হাতে খড়ি। সুনন্দার প্রেমে মজলেন আধারকার। কিন্তু হলে কী হবে এক তরফা। সেই প্রেমের আরেক পাগল কবি মিরাজ। তিনি লিখলেন...
‘‘বেভুল আধারকার সাক্ষাতে সুনন্দার
দিয়েছিল প্রাণ করেছিল আশা স্টেশনে হাওড়ার।’’
এ লাইন দুটো লেখা ছিল তার অঙ্কের খাতায়।
-অঙ্কের খাতায়? মিরাজ ভাই তখন কোন ক্লাসে পড়েন?
-দশম শ্রেণিতে।
-দশম শ্রেণিতে? মানে ওই বয়সে...?
-প্রেমের পাগল মানুষ যে কোনো বয়সেই হতে পারে।
-তো অঙ্কের খাতায় লেখা ছিল কবিতার দুটো লাইন। পরে কী হলো।
-হেড মাস্টার আবুল কাসেমের সামনে পড়ে গেলো। তিনি কবি মিরাজকে কিছুই বললেন না, শুধু নিচে লিখে দিলেনÑ ননসেন্স আধাকার। আধাকার ইজ এ ননসেন্স পারসন।
-তাই? সহেলি মিরাজের দিকে আড়চোখে তাকায়।
 -ও আচ্ছা, লেখক যাযাবর আপনার সাহস মাটি করে দিলেন কীভাবে?
-তিনি লিখেছেন, ‘‘প্রেমে পড়লে চেহারাট বড্ড বোকা বোকা লাগে। সে ভয়েই এগোতে সাহস করিনি।’’
-ও তাহলে এ জন্যই আপনিও এগোতে সাহস করছেন না?
-ধরে নিতে পারো।
-তাহলে তো ‘দৃষ্টিপাত’ পড়তে হয়।
-তোমার মতো চপলমতি মেয়ের ‘দৃষ্টিপাত’ ভালো লাগবে না।
-কেন ভালো লাগবে না?
-সে অনেক কথা।
-আরে কীসের, নিজের মুরাদ নেই দোষ যাযাবরের। আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর আরকি।
অনেকক্ষণ পর মিরাজ হুল ফুটালো।
-হাঃ হাঃ হাঃ। আপনাদের ঝগড়া শুনে আমি দারুণ মজা পাই। এত ঝগড়া করেও একসঙ্গে থাকেন কী করে?
-আমাকে ছাড়া যে ওর একদিনও চলবে নাÑতাই।
-না না, আমাকে ছাড়া ওর চলবে নাÑতাই।
-তাহলে মিরাজ ভাই ডালটা আপনিই রান্না কইরেন যতদিন না সিরাজ ভাইয়ের মনটা ভালো হয়।
-কত ঠেকছি।
-কথাটা স্ববিরোধী হয়ে গেল না?
-রেগে গেলে সবাই স্ববিরোধী কথা বলে।
-আচ্ছা ঠিক আছে, আপনাদের কাউকেই রান্না করতে হবে না। কোনো এক ফাঁকে আমি এসেই রান্না করে দিয়ে যাব?
-তাহলে তো খুব ভালো হয়। সিরাজ বলল।
-‘‘তাহলে তো খুব ভালো হয়’’ মুখ ভেংচালো মিরাজ। আর গাধা, চাচা-চাচী জানতে পারলে ঝাঁঠিয়ে বিদায় করবেন।
-জানবে না।
-এটা ভালো দেখাবে না। তাছাড়া তোমার পড়াশোনা আছে না? মিরাজ জোর দিয়ে বলল।
-বিনিময়ে আপনারা দু’জন আমাকে দিনে এক ঘণ্টা করে পড়াবেন। আপনি অঙ্ক-বিজ্ঞান আর সিরাজ ভাই বাংলা-ইংরেজি।
-এ প্রস্তাবটা অবশ্যই বিবেচনা করা যেতে পারে। সিরাজ বলল।
-না। বিবেচনা করা যেতে পারে না। এ কথা একদিন প্রকাশ পাবেই। তখন বিনা নোটিসে আমাদের ঘর ছাড়তে হবে। শুধু রান্না করে খাওয়ার ভয়ে নিরাপদ ঘরটা আমি ছাড়তে পারব না। মিরাজ আবারও দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
-আমি না হয় মাকে বলেই আসব।
-না না, চাচী কী ভাববেন? ভাবতেই আমার লজ্জা করছে। মিরাজ  বলল।
-আসলেই বিষয়টা ভালো দেখাবে না। অবশেষে আমাদের উপকার করতে এসে তোমার দুর্নাম হবে। এবার সিরাজ মিরাজের সঙ্গে একমত হলো।
-এতক্ষণে? দেখলে তো এতক্ষণে উনি আমার সঙ্গে একমত হয়েছেন।
নিচে সহেলির মায়ের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সহেলি সিঁড়িতে নেমে গেল।
-ঠিক আছে, আপনারা ঝগড়া করুন আমি যাই।
-আরে দাঁড়াও না। সিরাজ বলল।
-মা ডাকছেন। সে দ্রুত পা ফেলে নিচে নেমে যায়।
-দেখলে তো চাচির গলা শুনেই কেমন ছুট দিলো! মিরাজ বলল।
-যাবে না? ও কি আমার বউ নাকি? কথাটা বলে সিরাজ মিরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
-একটু ভদ্র হ। কথাবার্তায় শালিনতা রাখ।
-মনে হয় তোর খুব লাগল। মিরাজ শোন, সহেলিকে দেখলে তুই কেমন হয়ে যাস। ব্যাপারটা কী বলত।
-ব্যাপার আবার কি? ওকে আমার ভালো লাগে।
-তাই নাকি? তলে তলে জল খেতে শুরু করলি কবে থেকে।
-যখন থেকে ওকে দেখেছি।
-ভুল। এই একটা বাড়ি ছাড়া ওদের কিছুই নেই। তোকে ঘর জামাই করে থাকতে দেবে কোথায়?
-ঘর জামাই থাকব কেন? আমাদের কি ঘরবাড়ি নাই নাকি?
-না, আমি শুনেছি সহেলিকে যার সঙ্গে বিয়ে দেবে তাকে ঘরজামাই থাকতে হবে।
-আমি ঘর জামাই থাকলে তোর কী হবেÑতুই থাকবি কার সঙ্গে।
-বাব্বা! গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।
-ফাইজলামি রাখ। আমি কি সহেলির উপযুক্ত না?
-সেটা অবশ্য ভাবনার কথা। সহেলি যদি তোকে পছন্দ না করে?
-অবশ্যই সহেলি আমাকে পছন্দ করে।
-এত কনফার্ম হলি কীভাবে?
-আমার প্রতি ওর পক্ষপাতিত্ব দেখে। ওর চোখের চাহনি, মুখের ভাষা সবকিছু আমাকে বলে দেয়Ñও যে আমাকে চয়েজ করে।
-আমি যদি বলি, আমাকে চয়েজ করে। ওর চোখের চাহনি, মুখের ভাষা সবকিছু বলে দেয়Ñযে ও আমাকে পছন্দ করে। তাহলে?
 -হতেই পারে না। সহেলি তোর মতো একটা নিষ্কর্মাকে পছন্দ করতেই পারে না।
-তাই নাকি? আমি একটা নিষ্কর্মা? আচ্ছা। কিন্তু বন্ধু সাবধান! প্রথম প্রেমে যেন ছ্যাঁকা খেও না।
-আমাকে সাবধান করতে হবে না। তুই তোর নিজের চরকায় তেল দে।
-কিন্তু এখন পর্যন্ত যে আমাদের দু’জনের চরকা একটাই। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছি বিপদে আপদে দু’জন একসঙ্গে থাকব-এরকম শপথ করে।
-তাই বলে কোনো মেয়েকে ভালোবাসব না, বিয়ে করে কোনোদিন সংসারী হবো না?
-সময় হলে অবশ্যই। কিন্তু আগে ভালো কিছু কর, নিজেকে গড়ে তোল। আচ্ছা আমি চললাম। টিউশনি শেষে একটু পাবলিক লাইব্রেরিতে যাব। তুই যদি আগে বাসায় ফিরিস ভাতটা রেঁধে ফেলিস।
-হুম আমার তো ওই এক কাজ তোর জন্য ভাত রাঁধা।
সিরাজ বেরিয়ে যায়। ঝিম মেরে বসে থাকে মিরাজ। মাথাটা যেন বড় আওলাঝাওলা হয়ে গেছে তার। মনের গোপন কথাটা এত সহজে সিরাজের কাছে প্রকাশ করে ফেলবে আগে ভাবেনি। ভেবেছিল, সহেলির জন্য সিরাজ তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবে। কিন্তু সিরাজের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহই সে দেখেনি। এটা ভেবেই বরং সে বেশি অবাক হচ্ছে। আবার এ কথা সিরাজকে শুনিয়ে যতটা তার হালকা লাগবে ভেবেছিল-তাও লাগেনি। এবার নিজেকেই সে প্রশ্ন করে: ‘‘সহেলির ব্যাপারে এতটা আগ্রহ দেখানো কি ঠিক হলো? সিরাজের কাছে কি আমি ছোট হয়ে গেলাম না? আচ্ছা, এমন পাগলামি আমি কেন করলাম? সহেলির প্রতি যাতে সিরাজ আগ্রহী না হয় এ জন্য তো? কিন্তু সিরাজ যে বলল, সহেলি তাকে পছন্দ করে। ওর চোখের চাহনি, মুখের ভাষা সবকিছু বলে দেয়Ñযে ও তাকে চয়েজ করে। সত্যিই তো সহেলিরও পছন্দ থাকতে পারে। আমি এতটা নিশ্চিন্ত হলাম কী করে যে, সহেলি আমাকেই পছন্দ করে।’’
 আসরের আযান হচ্ছে। ওজু করে নামাজ পড়তে যায় সে।
(দুই)
সিরাজ মিরাজের বন্ধুত্ব বাল্যকাল থেকে। পাশাপাশি গ্রামে তারা বেড়ে ওঠেছে। দু’জন দু’জনের মায়ের হাতে রান্না খেয়েছে বছরের পর বছর। তারা তাদের বন্ধুত্বের দৃঢ়তার প্রমাণও নানাভাবে দিয়েছে বহুবার। স্কুলে পড়ার সময় অন্য বন্ধুরা কৌশলে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। একবার হলো কি, তাদের ক্লাসেরই একটি ছেলে, নাম জলিল, সিরাজের কলম লুকিয়ে ফেলে। সিরাজ যখন কলমটি খুঁজছে জলিল বলল, মিরাজকে দেখেছিলাম তোর ব্যাগে কী যেন খুঁজছে। হয়তো সেই নিয়েছে। তখনই মিরাজ ক্লাসে ঢুকল। সিরাজ বলল, মিরাজ তুই কলম নিয়েছিস?
-কই নাতো।
কিন্তু জলিল যে বলল।
কী জানি কী উদ্দেশ্যে বলেছে?
কিন্তু স্যার ক্লাসে এলেই তো কলমটা আমার লাগবে।
-আমার কাছে একটা বাড়তি আছে নিতে পারিস।
-তাহলে আমার কলমটা পাবো না?
-হয়তো পরে পাবি।
জলিল তখন ওপাশের জানালায় দাঁড়িয়ে কিট কিট করে হাসছে। যখন সে দেখল ঝগড়াটা লাগেনি ক্লাসে ঢুকল।
-কীরে জলিল, বললি যে মিরাজ নিয়েছে।
-হয়তো আমি অন্য কাউকে দেখেছিলাম। মনে কর আমিই নিয়েছি।
-এটা আবার কেমন কথা হলো।
- আরে দেখলাম, তোদের বন্ধুত্বটা কত গভীর।
-ওই এই কথা। কিন্তু এভাবে ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করা অন্যায়।
-সরি। জলিল বলল।
- শোন জলিল, সরি বললেই সব অপরাধ মাফ হয়ে যায় না। সিরাজ বলল।
-তাহলে তোরা কি আমাকে মারবি? মার তাহলে, সে জামা উঠিয়ে পিঠ দেখায়।
-না, মরাব না। কিন্তু শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব। মিরাজ বলল।
এরপর থেকেই তারা দু’জন জলিলের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। জলিল বহু দিন চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে আপোস করতে পারেনি। তাই জলিল একদিন হেড মাস্টারের কাছে বিচার দেয় যে,‘‘স্যার, ওরা দু’জন আমার সঙ্গে কথা বলে না।’’
হেড মাস্টার খুব রাগি মানুষ। দু’জনকেই কমনরুমে ডাকলেন।
ধমকও খেতে হলো সরিও বলতে হলো। হেড মাস্টার তিন জনের হাত মিলিয়ে দিলেন। কিন্তু এরপরও তারা জলিলের সঙ্গে কথা বলেনি। একসময় জলিল নিরাশ হয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলার আশাই ছেড়ে দেয়। এজন্য আজও তাদের অনুশোচনা হয়। সিরাজ বলে, জলিলের প্রতি আমরা অবিচার করেছিলাম।
-হ্যাঁ, যখনই বাড়ি যাই ওর সঙ্গে দেখা করব। বলব, দোস্ত ক্ষমা চাই।
কিন্তু গ্রামে যাওয়া আর হয় না। কর্মব্যস্ততা দিনদিন বাড়তেই থাকে। টিউশনি, টফেল, দেশিবিদেশি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার জন্য ক্লাশ করা আর স্কলারসিপের জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে ধর্ণা দেয়া। এসব করতে করতে কখন দিন কেটে যায় কেউ টেরও পায় না। কিন্তু এরইমাঝে দু’জনই নিজেদের অজান্তে প্রেমে পড়ে বাড়িওয়ালার মেয়ে সহেলির। সহেলিও নিঃসন্দেহে সবদিক দিয়ে দু’জনেরই যোগ্য মেয়ে। কিন্তু এই প্রেম তাদের বন্ধুত্বে ফাঁটল ধরায়, বিশ্বাসে আগুন লাগায়। এক কথায় প্রেম তাদের জীবনে ঝড় হয়ে দেখা দেয়।
 (তিন)
সিদ্ধান্ত হয় সপ্তাহের একদিন সিরাজ আরেকদিন মিরাজ সহেলিকে পড়াবে। তো যেদিন সিরাজ পড়াবে সেদিন মিরাজ পড়াবে না। সিরাজের বিষয় বাংলা, ইংরেজি আর মিরাজের বিষয় অঙ্ক ও বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়। যেমন জীব বিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থদ্যিা ইত্যাদি। সহেলির বাবা-মাও খুব খুশি বিনে পয়সায় এমন ভালো মাস্টার পেয়ে। তাও আবার পালা করে পড়ায়। সহেলির মা ভাবেন, মেয়ের আমার ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। না হলে এমন সোনার টুকরো দুটো ছেলে যেঁচে তাকে পড়াতে আসবে কেন। সহেলির বাবাও বেশ খুশি। তিনি তো প্রকাশ্যেই বলেন, ‘‘আরে তোমরা হলে ঘরের ছেলে। তোমরা সহেলিকে পড়াচ্ছ এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে।’’
ল¤¦া ও হালকা-পাতলা গড়নের সিরাজের গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। সবসময় হাসি খুশি। পোশাক ও চলাফেরায় বেশ স¥ার্ট। লজ্জাশরমের ধার ধারে না। মুখে যখন যা আসে সামনাসামনিই বলে ফেলে। অবস্থাপন্ন পরিবারের ছোট ছেলে। মা-বাবা গ্রামে থাকে। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তবে তার একটা সমস্যা আছে, মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে দ্বিধা করে না। এর অর্থ হলো, নিজে থেকেই সে বিপদ ডেকে আনে। সিরাজের এই একটা ব্যাপার সহেলির বাবার একদম না পছন্দ। এরপরও সহেলির জন্য এমন একটি ছেলে পেলে তারা বরং খুশিই হবেন। ভাবেন সহেলির বাবা।
অপরদিকে মিরাজ সিরাজের সম্পূর্ণ বিপরীত। মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে। মাঝারি উচ্চতার পেটা শরীর তার। গায়ের রঙ শ্যামলা। লাজুক স্বভাবের। থাকেও চুপচাপ। আত্মসম্মানবোধ খুবই প্রখর। কথা বলে মেপে পা ফেলে ভেবে। সারাদিন থাকে বই নিয়ে। কবি কবি ভাব। রাত জেগে কবিতাও লিখে, কিন্তু কাউকে পড়তে দেয় না। এমনকি বন্ধু সিরাজকেও না। তার ধারণা কবিতার মতো সেনসেটিভ জিনিস সিরাজ হজম করতে পারবে না। সহেলির বাবাও মিরাজকে বুঝতে পারেন না। তার চুপচাপ থাকাটা তার অসহ্য লাগে। তিনি ভাবেন, পরিবারের বড় ছেলের দায়িত্ব অনেক। নিজের লেখাপড়া শেষ করার আগেই উপার্জনের কথা ভাবতে হয়। ছোট ভাইবোনদের মানুষ করা, সংসারের হাল ধরা ইত্যাদি। এত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে গিয়ে অনেকেই নিজের জীবনে সুখী হতে পারে না। সহেলির বাŸা নিজেও এই দলের অন্তর্ভূক্ত। তাই তিনি চান না সহেলি কারও সংসারের বড় বউ হোক। একদিন মিরাজ সহেলিকে পড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি সহেলিকে বলেন,
-এই ছেলেটা এমন কেন? এই বয়সে মন খুলে হাসে না। আমি ওকে কোনোদিন হাসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
-আমার কিন্তু এমন মনে হয় না আব্বা। ভাবুক মানুষ তো।
-ভাবুক?
-হ্যাঁ, কবিতা লিখেন তো। আপনি শুনবেন তার কবিতা?
-না থাক।
‘‘মিরাজের প্রতি মেয়ের পক্ষপাতিত্বের কারণ তাহলে এই।’’ ভাবেন তিনি। ‘‘ছেলেটা এমনে কথা বলে না কিন্তু মেয়েকে পড়ানোর সময় মুখে খৈ ফুটে। হরদম বকবক করতেই থাকে।’’
(চার)
রুটিন অনুযায়ী আজ সহেলিকে পড়াচ্ছে সিরাজ। সহেলি ইংরেজি বই বের করে বলল, সিরাজ ভাই, ‘আজ থ্রি কোশ্চেন’ পড়াবেন। ‘থ্রি কোশ্চেন’ টলস্টয়ের লেখা। বিষয়টা মনে হয় খুব ইন্টারেস্টিং কিন্তু আমি বুঝি না। ইংরেজির ম্যাডাম মিন মিনে গলায় বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কীসব বলেন আমায় মাথায় ঢোকে না।
সিরাজ বইটা টেবিলের ওপর ওপুড় করে রেখে বলে, দেখো, লেখকের নামের উচ্চারণটা টলস্টয় নয়, তলস্তয়। লিও তলস্তয়। আমি কি মনে করি জানো?
সহেলি এতক্ষণ সিরাজের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। কী যেন ভাবনায় ব্যাকুল সে। বলল,
-না সিরাজ ভাই।
-জানবে ক্যামনে মাথায় তো ভূত চেপেছে।
-মানে? বুঝলাম না। সহেলি হাসে।
-দয়া করে মনোযোগ দাও।
-আচ্ছা দিচ্ছি।
-তুমি যদি লেখক তলস্তয়ের লেখা বুঝতে চাও আগে তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করো। শোনো, তলস্তয় ছিলেন বিশ্বের আদর্শবাদী লেখকদের গুরু। ন্যায়ের প্রচারণায়ও তিনি অদ্বিতীয়। আমার মতে, তাঁর ‘থ্রি কোশ্চেন’ তেমনই একটি আদর্শবাদী লেখা। যা একান্তই শিক্ষামূলক। একজন মানুষ তার সময় ও তার সঙ্গের মানুষকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে তলস্তয় এখানে তা দেখিয়েছেন। যেমন, এই যে এই মুহূর্তটা এটাই তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। কাজেই এ সময়টা তুমি কাজে লাগাও। এ মুহূর্তে আমি রয়েছি তোমার সঙ্গে। এ হিসেবে এ মুহূর্তে আমিই তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তুমি আমাকে কাজে লাগাও।
-লাইলি মনে মনে বলে, সিরাজ ভাই তো ভালোই সুযোগ পেয়েছেন। ‘থ্রি কোশ্চেন’ বোঝাতে বসেÑনিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছেন।
-আরে কী ভাবছ, শোনো! তলস্তয় ছিলেন একজন পুরোদস্তর দার্শনিক। অনেকেই অবশ্য তাঁকে শুধুই লেখক মনে করেন। ও আচ্ছা, তুমি তাঁর ‘ওয়ার এন্ড পিস কিংবা ‘অ্যানা কারিনিনা’ এসব উপন্যাস পড়েছ?
-পড়ব কী আজও তো দেখিইনি।
-তাই বলো। বিশাল আকৃতির এসব উপন্যাসে তলস্তয় বছরের পর বছর ধরে সময় দিয়েছেন। এরপর সিরাজ তলস্তয় সম্পর্কে একটা বক্তৃতা ঝাড়ে। কিন্তু এরপরও সহেলি মনোযোগ দিয়েছে বলে তার মনে হলো না।
-সহেলি তুমি কিন্তু মোটেই মনোযোগ দিচ্ছ না।
-জি ভাইয়া।
-কী হয়েছে?
-আমি খুব অন্তর্দ্বন্দে¡ ভোগছি।
-কীসের অন্তর্দ্বন্দ¡?
-আপনাকে বলা যাবে না।
-আমি জানি। তোমার মুখ দেখলেই আমি সব বুঝে নিতে পারি।
-গুল মারছেন?
-না, বলব?
-বলেন।
-তুমি আমাদের দু’জনকে নিয়ে ভাবছ?
-হ্যাঁ, না না। আপনাদের দু’জনকে নিয়ে আমি কী ভাবব?
-কী ভাবছ সেটা তুমি জানো।
-ও হ্যাঁ সিরাজ ভাই, আমার একটা প্রশ্ন আছে।
-করো।
-আপনাদের দু’জনের মধ্যে বেশি ভালো ছাত্র কে?
-এটা কেমন প্রশ্ন হলো?
-বলুন না, কারণ আছে।
-আগে বলো এ প্রশ্ন কেন করছ?
-বলতে পারেন জাস্ট কৌতূহল।
- আমরা দু’জনেই তো তোমাকে পড়াইÑতুমি বুঝতে পারো না?
-সবটুকু পারি না। তাই আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি।
-মিরাজ। ও আমার চেয়ে অনেক গুণ বেশি মেধাবি। স¥ৃতিশক্তিতে ওর ধারেকাছেও আমি নেই। বাংলা ইংরেজি পড়ালেও সে আমার চেয়ে অনেক ভালো পড়াত।
-এবার তুমি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
- প্রশ্নটা করুন।
-কথা দাও সঠিক ও সত্য উত্তরটা দেবে।
-কথা দিলাম, সঠিক ও সত্য উত্তর দেবো।
-তুমি কাকে বেশি পছন্দ করো। আমাকে না মিরাজকে।
-উত্তরটা জানা কি খুব দরকার।
-হ্যাঁ, খুব দরকার।
-মিরাজ ভাইকে।
-গুড। কষ্ট হলেও শুনে ভালো লাগছে।
-কষ্ট হচ্ছে কেন?
-না, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকেই বেশি পছন্দ করো।
-আমি আপনাকেও অনেক পছন্দ করি।
-কিন্তু ....
-কিন্তু কী?
-ভালোবাসো কাকে?
-এটা বলব না।
-কেন বলবে না?
-একথা বলার সময় এখনো আসেনি যে।
-গুড। ইন্টেলিজেন্ট গার্ল।
(পাঁচ)
মিরাজ পড়াচ্ছে পদার্থ বিদ্যা।
-মিরাজ ভাই, আইনস্টাইনের কোনো তত্ত্বই আমার মাথায় ঢোকে না। ‘ই ইজ ইকুয়েল টু এম সি স্কোয়ার’ তাঁর বিখ্যাত সুত্রটা একটা বিদঘুটে ব্যাপার....।
-আইনস্টাই উনিশ ও বিশ শতাব্দির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানি ও চিন্তাবিদ। ‘ই ইজ ইকুয়েল টু এম সি স্কোয়ার’ এ সূত্রটা তিনি জাহির করেছেন তাঁর চিন্তার পূর্ণতা পাবার পর। আর তুমি একটা পুচকা মাইয়া। তোমার কি এটা এত সহজে বোঝার কথা?
-আরও বোঝলাম না।
-বুঝবে কেমন করে তুমি নিজেই এখন একটি তত্ত্বের জন্ম দিতে যাচ্ছ।
-মানে?
-মানে খুব সহজ। তুমি এখন একটা কঠিন অন্তর্দ্বন্দে¡র সময় পার করছ।
-ঠিক ধরেছেন। আমি যখন আইনস্টাইনের তত্ত্ব পড়ি তখন কেবল আপনার কথাই আমার মনে পড়ে।
-আইনস্টাইনের তত্ত্ব পড়তে গিয়ে আমার কথা মনে পড়ে কেন?
-কারণ আপনি এত পড়াশোনা করেন যে ভাবতেই আমার মাথা গুলিয়ে যায়। খালি ভাবি, আইস্টাইনকে না জানি কত বেশি পড়তে হয়েছে।
-ও এই কথা?
-এই কথা নাতো কি? আপনি ভেবেছিলেন আমি আপনার প্রেমে পড়েছি?
-যদি এমনটা ভেবেই বসি খুব কি ভুল হবে?
-জানি না।
-হেঁয়ালি ছাড়ো।
-আমি একবার পড়েছিলাম, শেকসপিয়ার বলেছেন, ফ্রিইলটি দাই নেম ইজ উইম্যান।
-মানে?
-সবচেয়ে হেঁয়ালি হচ্ছে মেয়েদের মন।
-তো? আমিও মনে করি আমি একটা কঠিন হেঁয়ালির মধ্যে রয়েছি। আমার চারপাশে এই যে আপনারা আছেন তারা আমার কেউ না। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না....
-কাকে ভালোবাস?
-হ্যাঁ। না-না। এখানে ভালোবাসার কথা আসছে কেন?
-কারণ এটা তোমার ভালোবাসার বয়স। ভালোবাসতে পারলে তুমি যত সুখ পাবে অন্যকিছুতে পাবে না। প্রেমে পড়লে যত খুশি হবে অন্যকিছুতে সম্ভব না।
-তাই নাকি। ভালোবাসা সম্পর্কে তো ভালোই জানেন দেখছি। অ্যামনে তো মনে হয়, ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেন না।
-পড়াশোনা করে তবে জেনেছি।
-এসব কথা কি বই পুস্তকে আছে নাকি?
-বই পুস্তকে কী নেই সেটাই বলো।
-আচ্ছা বাদ দিন। এবার ক্লাসের পড়া।
 -কিন্তু আমাদের পাঠ্যবইগুলোতে শুধু তত্ত্ব দেয়া থাকে। কবি, লেখক ও বিজ্ঞানীদের জীবনী দেয়া থাকে না। তাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কাহিনী দেয়া থাকে না। আমার মতে, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের কোনো একটা পর্যায়ে  জীবনীগ্রন্থ পাঠ্য করা উচিত।
-হ্যাঁ, আমারও খুব জানতে ইচ্ছে করে ব্যক্তি জীবনে আইস্টাইন কেমন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, জনাতন সুইফট এমনই আরও অসংখ্য মহামানব কেমন ছিলেন তাদের ছেলেবেলায়। কে কেমন জীবন যাপন করতেন। কতটা সংগ্রামের পর তাঁরা জীবনে সফল হয়েছেন। স্ত্রী, পুত্র, কন্যার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের আচরণ কতটা স্বাভাবিক ছিলÑএসব বিষয় আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।
-তুমি পড়তে চাইলে আমি তোমাকে জীবনীগ্রন্থ সংগ্রহ করে দিতে চেষ্টা করব।
-ধন্যবাদ। ও আচ্ছা, আপনাকে একটা প্রশ্ন করার ছিল। বলুন রাগ করবেন না।
-আচ্ছা রাগ করব না।
-আপনাদের দু’বন্ধুর মধ্যে কে বেশি ভালো ছাত্র?
-এ প্রশ্ন করছ কেন?
-না, এমনিতেই। বলতে পারেন জাস্ট কৌতূহল।
-দুজনেই আমরা তোমাকে পড়াইÑতুমি বুঝতে পারো না?
-সবটুকু পারি না। তাই আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি।
-সিরাজ। ও আমার চেয়ে অনেক বেশি মেধাবি। অঙ্ক বিজ্ঞান পড়ালেও আমার চেয়ে ও অনেক বেশি ভালো পড়াত।
-এবার আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
- প্রশ্নটা করুন।
-কথা দাও সঠিক ও সত্য উত্তরটা দেবে।
-কথা দিলাম, সঠিক ও সত্য উত্তর দেবো।
-তুমি কাকে বেশি পছন্দ করো, আমাকে না মিরাজকে?
-উত্তরটা জানা কি খুব দরকার?
-হ্যাঁ, খুব দরকার।
-সিরাজ ভাইকে।
-তাই? কিন্তু আমি যে তোমাকে....
-আপনি বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন।
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমি বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি। সরি, ভেরি সরি। আমি এখন যাই।
-কেন, কী হয়েছে? এখনই যাবেন কেন?
-আমার ভালো লাগছে না। সরি আমার ভুল হয়ে গেছে। সিরাজ ঠিকই বলেছিল।
মিরাজকে কেমন অসুস্থ্য দেখাচ্ছে। সে বারবার মাথার চুলগুলো ঠেলে ওপর দিকে দিচ্ছে। ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘামছে। সহেলি ছুটে গিয়ে এক গেলাস পানি নিয়ে এলো,
-আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে আপনার? এই যে পানিটা খান।
 সে সহেলির হাত থেকে গেলাসটা নিয়ে একটানে সবকটুকু পানি খেয়ে ফেলে।
-সিরাজ ভাই কী বলেছিলেন?
-যদি সময় পাই পরে কোনোদিন বলব। এখন আমি যাই।
-মিরাজ ভাই, চা টা অন্তত খেয়ে যান।
-না, এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে না।
(ছয়)

এটা ক’দিন পরের ঘটনা। সহেলির বাবা বাজার থেকে ফিরছেন। দু’হাতে দু’টি সওদা ব্যাগ। একই সময় সিরাজ কোথাও থেকে বাসায় ফিরছে। সহেলির বাবার সঙ্গে বাসায় প্রবেশের মুখে দেখা হয় তার। সিরাজ বলল,
-চাচা করছেন কি। আপনার হাত তো ছিঁড়ে যাচ্ছে। একটা ব্যাগ আমাকে দিন।
-না বাবা, তোমার কষ্ট করতে হবে না। আমিই নিতে পারব।
-কী যে বলেন চাচা। দেন একটা। আপনার ছেলের মতো আমাদের মনে করতে পারেন না।
-ছেলের মতোই তো মনে করি। শোনো, আজ দুপুরে তোমরা দু’জন আমাদের সঙ্গে খাবে।
-চাচা এর কি দরকার আছে?
-দেখো, তোমরা নিজেরা রান্না করে কী খাও না খাও ভেবে আমার খুব খারাপ লাগে।
-অচ্ছা ঠিক আছে চাচা। আপনি যখন বলছেন।
-মিরাজকেও নিয়ে এসো কিন্তু।
সিরাজ দরজার কাছে ব্যাগ রেখে চলে গেলে পেছন থেকে তিনি বলছেন, কত ভদ্র পরিবারের ছেলে হলে এমন অমায়িক অচরণ করে। এ ছেলেটাকে আমি যত দেখছি তত আপন মনে হচ্ছে।
-দরজা খুলে সহেলি বেরিয়ে আসে। কার কথা বলছেন আব্বা?
-ওই সিরাজ ছেলেটার কথা।
-কী করেছে?
-বাজার থেকে আসছি দেখে ব্যাগটা ঘরের দুয়ার পর্যন্ত দিয়ে গেল।
-আব্বা, এটা তো খুব সাধারণ একটা কাজ। এতেই আপনি তার এত প্রশংসা করছেন?
-শোন, বড় মানুষদের চেনা যায় ছোট মানুষদের সঙ্গে তার অচরণের নমূনা দেখে।
-আব্বা আপনি তো দার্শনিকদের মতো কথা বলছেন।
-খুব সাধারণ মানুষের জীবনে যখন অসাধারণ কিছু প্রাপ্তি ঘটে তখন সে দার্শনিক হয়ে যায়। তার অনুভূতির স্তর তাকে উঁচু মার্গে পৌঁছে দেয়।
-আব্বা এসব আপনি কী বলছেন?
-থাক এসব কথা। শোন, এই যে বাজার এনেছি। দু’জনকে দাওয়াত করেছি। তারা দুপুরে খাবে। তোর মাকে বলিস। ও তোর মা কোথায় তাকে তো দেখছি না।
-মা সালু আপাদের বাসায় গেছে। এখনই চলে আসবে।
-অচ্ছা বলিস। আমি সেলুনে যাচ্ছি চুলটা ছোট করে আসি।
-আচ্ছা যান। ও আচ্ছা, কাকে দাওয়াত করলেন বললেন না তো।
-আসলেই দেখতে পাবি।
-আম্মা যদি জানতে চায়।
-তোকে যা বললাম, তাই বলবি।
-আব্বা, রান্না কী কী করতে হবে-তাওতো বলেননি।
-শাদা ভাত। মাছ, মাংস, ডাল। মিষ্টি আর দইয়ের অর্ডার আমি দিয়ে এসেছি। ওরা দিয়ে যাবে।
-অচ্ছা। আপনি যান।
সহেলির আব্বা চলে গেলে সহেলি মাছ-মাংসের পুটলাগুলো খুলে পানিতে ভেজাচ্ছে। দু’জাতের মাংসই আছে। গরু আর মুরগি। সে মনে মনে বলে:
-আব্বা কাদের দাওয়াত করল? নাম বলল না। নতুন জামাইয়ের জন্যও তো মানুষ এত বাজার করে না। নাকি সিরাজ ভাইদের? যাই আম্মা আসার আগেই সংবাদটা জেনে আসি। ওপরে গেলেই তো জানতে পারব।
সিরাজ ওপরে সেভ হচ্ছে। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে গালে সাবান মাখছে। সহেলিকে দেখে মুখটা মুছে ফেলল।
-আমি এসে আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম?
-নাহ্, কেন এসেছ তাই বলো। ভেতরে এসে বসো।
-না, এই দেখতে এলাম আপনারা দু’জনই আছেন কিনা। ভাবছি আজ দুপুরে এসে রান্না করে দেবো।
-না না, আজ তো আমাদের দু’জনেরই দাওয়াত।
-দাওয়াত? আপনারা কি মুন্সী-মওলানা যে মানুষে দাওয়াত করবে?
-হাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ। মুন্সী-মওলানা না হলেও যে দাওয়াত পাওয়া যায় এটা এবার আমরা দেখিয়ে দিলাম।
-তো আপনাদের দাওয়াতটা করল কে শুনি?
-স্বয়ং তোমার আব্বাজান এবং আজ দুপুরেই আমরা তোমাদের ঘরে খেতে যাচ্ছি।
-বাঃ! আব্বাকে তো আপনারা ভালোই জাদু করেছেন দেখছি।
-আরে জাদুটাদু কিছু না। অন্য ব্যাপার আছেÑসময় হলেই বুঝতে পারবে।
-আপনিই বলেন না ব্যাপারটা কী?
-আরে আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখতে পায়। তুমিও পাবে।
-ও তাহলে বলবেন না? আচ্ছা ঠিক আছে এখন যাই। মনে মনে বলে : ‘‘আমার যা জানার জেনে গেছি’’। নিচে যাচ্ছে আর ভাবছে, ‘‘আব্বা হঠাৎ তাদের দাওয়াত করল কেন?’’ তখন তার মা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছেন।
-কি রে তোর আব্বা বাজার দিয়ে গেছে?
-হ্যাঁ মা। ও মা, আব্বা দু’জন মেহমান দাওয়াত করেছেন। তারা দুপুরে খাবে।
-কাদের দাওয়াত করেছে জানিস কিছু।
-বলেননি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বললেন, আসলেই তো দেখতে পাবি।
-তোর বাপটা মাঝেমধ্যে অদ্ভুদ আচরণ করে। কাদের দাওয়াত করেছে নাম বললে কী হতো?
-মা, আব্বা না বললেও আমি বুদ্ধি করে জেনে ফেলেছি?
-কী বলছিস? কারা তারা?     
-সিরাজ ভাইয়েরা।
-তাই নাকি, হঠাৎ তোর বাবা ওদের দাওয়া করল কেন?
-মা সব রান্না কিন্তু আমি করব।
-করতে চাইলে করবি?
-হ্যাঁ, দেখি বড় রান্নার কাজ আমি করতে পারি কিনা।
-মা, আব্বাকে কিন্তু বলবেন না দাওয়াতি মেহমানদের কথা আপনি জানেন।
-কেন? কোনো সমস্যা?
-না, বোঝেন না আব্বা নিজে যেহেতু বলতে চাননি।
-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তোর আব্বার মতলবটা কী?
-মতলব আর কি ছেলে পছন্দ হয়েছে মেয়ে বিয়ে দেবেন।
-যা, বেলাজ মাইয়া। মায়ের মুখের ওপর এমন কথা কেউ বলে?
-সরি আম্মা। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।
-আচ্ছা বলত তোর কাকে বেশি পছন্দ? সিরাজকে না মিরাজকে?
-কাউকেই না।
-কী বলছিস? আসলে আমিও না বুঝতে পারি না। দু’জনেই ভালো। কারও চেয়ে কেউ কম বেশি না।
-আচ্ছা মা, আপনি বলুন তো কাকে আপনার বেশি পছন্দ?
-অন্তর্দ্বন্দ¡ আমার মধ্যেও। তবে সিরাজকেই আমার বেশি পছন্দ। মিরাজ অবশ্যই ভালো কিন্তু ওদের পারিবারিক অবস্থা ভালো না। তাছাড়া ও পরিবারের বড় সন্তান।
-পারিবারিক অবস্থা ভালো না, পরিবারের বড় ছেলে এসব কি কোনো সমস্যা? আব্বাও তো পরিবারের বড় ছেলে।
-মিরাজকে তোর পছন্দ?
-মা!
-আমি বুঝি। আমি তোর মা।
-মিরাজ ভাই কী সুন্দর কবিতা লিখে মা।
-ওর একটা কবিতা তুই আমাকে পড়ে শোনাস তো মা।
-আচ্ছা।
-কই সহেলি তোর মা ফিরেছে? সহেলির আব্বা নিচে থেকেই জিজ্ঞেস করছেন।
-মা ওই আব্বা আসছেন। জি আব্বা।
-শোনো ওপরের ছেলে দুটোকে দাওয়াত করেছি। দুপুরে ওরা আমাদের সঙ্গে খাবে।
-ভালো করেছেন। ছেলে দুটোকে এমনিতেই মাঝেমধ্যে খাওয়ানো দরকার। বাবা-মা ছাড়া থাকে। কী খায় না খায়?
-হ্যাঁ, এজনই তো আমিও বললাম।

(সাত)

মিরাজ কিছুতেই খেতে আসবে না। সিরাজ বলে,
-আমি কথা দিয়েছি তোকে নিয়ে যাবো। তোকে বলার জন্য তিনি আসতে চেয়েছিলেন। আমি না করেছি।
-তুই না করলি কেন?
-আমাদের একজনকে বললেই তো হয়।
-না হয় না। দাওয়াত না পেয়ে দাওয়াত খেতে যাওয়ার চেয়ে ছোঁচামি আর কিছুতে নেই।
-তুই সবকিছু জটিল করে ভাবিস। এতক্ষণ তো ছিলাম বেশ ফুরফরা মেজাজে। বন্ধুর হবু শ্বশুড় বাড়িতে একটু ভালোমন্দ খাবো।
-যা খা গিয়ে। তোকে তো যেতে মানা করিনি।
-তুই না গেলে কি আমি যেতে পারি? সব আয়োজন তো তোর জন্য।
-আমার জন্য হলে তো দাওয়াত আমিও পেতাম। বরং বল তোর জন্য।
-ছি! আমার জন্য বলে কি আমি তোর বুকটা ভেঙে দিতে পারি?
- আমার কথা ভাবিস না। তুই যা।
-তুই যাবি না কেন? তুইও তো দাওয়াতি মেহমান।
-আমার যেতে উচ্ছে করছে না, ব্যাস।
-মিরাজ দয়া করে কোনো সিন ক্রিয়েট করিস না, চাচা বসে আছেন।
-যা আমি পরে আসব।
-তোকে ছাড়া আমি যেতে পারি না। দাওয়াত তোর জন্য। তোকে ছাড়া গিয়ে কি আমি আঙুল চুষব নাকি?
-ফাইজলামি রাখ।
-ফাইজলামি না দোস্ত। এক্কবারে মনের কথা। পরের জীবনে ওদের এখানে খাওয়ার সুযোগ তুই দিবি কি না জানি না। তো আজকেরটা কিছুতেই মিস করতে বলিস না।
-যাস না কেন? আমি কবে না করলাম।
-তোর যেতে না চাওয়াটাই ইনডিরেক্টলি আমাকে না করার সামিল। তাছাড়া, এটা আমার আর চাচার দু’জনেরই অপমান।
-চাচার অপমান?
-হ্যাঁ, মুরব্বি মানুষ। কী ভাববেন চিন্তা করেছিস?
-আচ্ছা ঠিক আছে। দাওয়াত না পেয়ে দাওয়াত খেতে যাচ্ছি-মনে রাখিস কিন্তু।
-এতে আবার মনে রাখারাখির কী আছে?
মিরাজ গিয়ে পাঞ্জাবি-পাজামা পরেছে। সিরাজ একটি তিব্বত আতরের নীল শিশি নিয়ে এলো।
-নে একটু আতর দিয়ে নে।
-মরার আতর আমি দিই না।
-আরে বেকুব চাচা আতর খুব পছন্দ করেন। পাজামা-পাঞ্জাবিতে তোকে যা লাগছে তার ওপর যদি আতর লাগাস তাহলে....
-তাহলে কি?
-চাচা হয়তো আজই কাজী ডাকতে বলবেন। সে তার পাঞ্জাবিতে আতর লাগাতে লাগাতে বলে।
-এ্যা, তুই কি আমাকে আবুল পেয়েছিস নাকি?
-না দোস্ত, আবুল তো আমি।
একই টেবিলে খেতে বসেছে তিনজন। সহেলির আব্বা, সিরাজ আর মিরাজ। সহেলি আর তার মা পরিবেশন করছে। সদ্য øাতা সহেলি পরেছে প্রিন্টের নীল জর্জেট শাড়ি। শাদা-সবুজ মিহিন ওড়না দিয়ে মাথা কাঁধ অবদি ঢেকে দিয়েছে। কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ। সহেলির বাবা মেয়েকে এভাবেই পরিমিত পোশাকে অভ্যস্ত করেছেন। মিরাজ লাজুক চোরা চোখে একটু একটু সহেলির দিকে তাকাচ্ছে। আর সিরাজ তাকাচ্ছে মিরাজের দিকে।
-সিরাজ, মিরাজ লজ্জা করো না। মনে করো এটা তোমাদের নিজেদের ঘর। বললেন সহেলির বাবা।
-জি চাচা, তাইতো মনে করি। সিরাজ বলল।
-শোনো, আজকের সব রান্নাই করেছে তোমাদের ছাত্রী। বললেন সহেলির মা।
-তাই নাকি? সিরাজ হাসি হাসি মুখে বলল।
খাওয়া শুরু হলেও মিরাজের অড়স্ট ভাবটা কাটেনি। সহেলির বাবা বললেন, মিরাজ কোনো কারণে তোমার কি মন খারাপ?
-জি না।
-শোনো। খাওয়ার সময়টা অন্তত মন ভালো রাখবে। সুস্বাস্থ্যের জন্য বিষয়টা খুব দরকারী।
-জি।
-চাচা মিয়া, মন যদি কোনো কারণে এমনিই খারাপ থাকে তো কী করবে সে?
-কিছু কি হয়েছে?
-না, কিছু হয়নি।
-হয়ে তাকলে বলো, সংকোচ করো না।
-কিছু হয়নি। ওর কথায় কান দেবেন না চাচা। মিরাজ বলল।
-আচ্ছা সিরাজ তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। ভেবেচিন্তে উত্তর দিও।
-করুন চাচা।
-সংসারটা আসলে কী? এই যে তোমার চাচীকে নিয়ে আমি আছি। আমাদের সন্তানরা আছে। একই রকম তোমাদের পিতা-মাতা আছেন। তারাও সংসার করেছেন।
-সংসারটা হলো একটা ভালোবাসার বন্ধন। এই বন্ধনটা খুবই সুখের হতে পারে যদি প্রত্যেকেই সহনশীল হয়। ত্যাগী হয়। ভালোবাসার আরও দু’টি নাম হলো, ত্যাগ, সহনশীলতা। আরও একটা নাম আছে, কম্প্রোমাইজ। মানে, মানে আপোস করা, মানিয়ে নেয়া। আমি এরকমই বুঝি।
-দারুণ বলেছ বাবা। সহেলির বাবা বললেন।
-হ্যাঁ, খুব সুন্দর অইছে। বললেন সহেলির মা।
-মিরাজ তুমি বলো-ভালোবাসা জিনিসটা কী? এই যে ধরো চারপাশে মানুষ এত পাগল ভালোবাসার লাগি। এ জিনিসটা আসলে কী? তুমি কি বোঝ তাই বলো।
-ভালোবাসা হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নাম। যেখানে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ থাকে না সেখানে ভালোবাসা থাকে না।
-ঠিক।
-আচ্ছা সহেলি বলতো, ভালোবাসা ছাড়া সংসার চলতে পারে কি?
-চলতে পারে আব্বা। আমাদের দেশে অনেক পরিবার আছে যেখানে কোনো ভালোবাসা নেই। তবু মানুষগুলো আছে। তবে সেটাকে হয়তো সুখের সংসার বলা যায় না।
-বা! আমার মেয়েও তো দেখি বুদ্ধিবতির মতোই কথা বলছে। আমি আসলে আমার মেয়েকে যতটা ছোট ভেবেছিলাম সে আসলে ততটা ছোট নেই। 
-আব্বা, আমি ইন্টামিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।
-হ্যাঁ, আমার মনেই ছিল না যে, তুইও কলেজে পড়ছিস। আচ্ছা মিরাজ তুমি কি একবাক্যে বলতে পারো সুখ জিনিসটা কী?
-জি চেষ্টা করতে পারি। সুখ হলো শান্তি ও তৃপ্তির একটি অবস্থা।
-সিরাজ তুমি কি মিরাজ যা বলল এর ব্যাখ্যা দিতে পারো?
-জি চেষ্টা করতে পারি। আমার মতে সুখ হলো শান্তি ও তৃপ্তির সমন্বয়। সুখের বিরপীত হলো অসুখ, অস্বস্তি। অসুখটা শারীরিক বা মানসিক হতে পারে। আবার এ দুটোও একসঙ্গে হতে পারে। অস্বস্তি হলো অসুখের কারণে সৃষ্ট পীড়ন।
-এত কঠিন?
-আচ্ছা মিরাজ তুমি বলো সংসার কী?
-সংসার হলো খেলাঘর। এখেলায় কেউ হারে কেউ জিতে।
-সত্যি তুমি কবি। কবির মতোই উত্তর দিয়েছে।
-ধন্যবাদ চাচা।
-তোমরা সবাই উন্নত চিন্তার অধিকারী। আমার খুব ভালো লাগছে তোমাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপ করতে পেরে। আমি অন্তত এইটুকু বুঝতে পারছি উপকার করতে না পারলে তোমরা কেউ কারও ক্ষতি করবে না। তোমরা দু’জন সহেলিকে পড়াচ্ছ। কখনো তোমরা তার শিক্ষাগুরু, সমবয়সী হিসেবে কখনো ভাই, কখনো বন্ধু।
-জি চাচা। সিরাজ বলল।
-মিরাজ তোমার বন্ধু সিরাজকে আমার খুব পছন্দ। তোমাকেও। তুমি তো বোঝো পছন্দেরও আবার রকমফের আছে। তুমি সিরাজের হয়ে ওর গার্ডিয়ানদের প্রধানের কাছে আমার এই পছন্দের কথাটা জানিও। তারা প্রয়োজন মনে করলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তবে এর জন্য কোনো তাড়াহুড়ো নেই।
-বুঝতে পারলাম না চাচা। কোন ব্যাপারে?
-সহেলির বিয়ের ব্যাপারে। আমার ইচ্ছা, ওর পরিবারের পক্ষ থেকে আপত্তি না থাকলে তার সঙ্গে আমরা সহেলির বিয়ে দিই।
-চাচা সিরাজের মতামত....
-আশা করি ওর অমত হবে না।
-জি আমি তার গার্ডিয়ানদের সঙ্গে কথা বলব।
সহেলির আব্বার কথা শুনে সিরাজের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে কোনো রকমে হাত ধুয়ে বিদায় নেয়। সহেলিও সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘরে চলে যায়।
Ñসহেলির মা হতব¤ে¦র মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মিরাজ হাত না ধুয়েই টেবিল ছাড়ে।

(আট)

সিরাজ  ভাবতেই পারেনি এমন একটা কথা তাকে শুনতে হবে। সহেলিকে সে পছন্দ করে, বিয়েতেও অপত্তি নেই। কিন্তু মিরাজ যাকে তার পছন্দের কথা খোলাখুলি বলেছেÑতাকে নিয়ে সে আর ভাবতে চায় না। এটা গর্হিত কাজ। সে বহুবার নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেছে তার মনের আপাত ইচ্ছেতেও কোথাও সহেলি  ছিল না। কিন্তু যেদিন মিরাজ বলল : সহেলি তোকে নয় আমাকে পছন্দ করে। সেদিন থেকে একটা জেদ চেপেছে তার মনে। অনিশ্চিন্ত অন্ধকারেও সে একটা ঢিল ছুঁড়ে। মিরাজকে বলে : সহেলি তোকে নয় আমাকে ভালোবাসে। একই সঙ্গে সে একটা বাজি ধরে। সহেলিকে চাই না কিন্তু জয় করতে অসুবিধা কোথায়? সব বিজয়েই তো শুনেছি আনন্দ আছে। সে মনে মনে বলে : ‘‘আমি প্রমাণ করে ছাড়ব সহেলি তোকে নয় আমাকে ভালোবাসে।’’ কিন্তু আজ সহেলির আব্বার প্রস্তাবে তার মনে হচ্ছে, সে হেরে গেছে। সহেলিকে জয় করার চিন্তাটা তাকে বাদ দিতে হচ্ছে। কারণ রক্তপাতহীন যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ায় যেমন গৌরব কোনো নেইÑতেমনই ত্যাগহীন প্রেমেও কোনো গৌরব নেই। মন খারাপ করে ঘরে বসে এসব কথাই ভাবতে থাকে সে। অল্পক্ষণ পরেই রুমে প্রবেশ করে মিরাজ। সে বাথরুমে গিয়ে হাত ধুয়। এরপর নিঃশব্দে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। এভাবে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে বলে :
-কনগ্রাচুলেশনস বন্ধু। তোর জীবনে উত্তর উত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি। তার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট কান্নাভারি।
-সিরাজ কিছু বলে না।
-তো একটা প্রতিবাদ না করে পারছি না। আমাকে ডেকে নিয়ে অপমান না করলেও পারতি। আগে থেকেই তো জানতি-এমন একটা ঘোষণা আসছে।
-সিরাজ পূর্বের মতোই নিরব।
-চাচার নির্দেশ বা অনুরোধ অনুযায়ী আমাকে কাল-পরশুর মধ্যে গ্রামে যোগাযোগ করতে হয়। তুই কী বলিস?
-খবরদার এ কাজটি করবি না।
-কেন?
-আমি কিচ্ছু জানি না। এ সিদ্ধান্ত আমার না চাচার।
-বা! কী সুন্দর অভিনয় করছিস?
-আমি জানি তুই আমার কথা বিশ্বাস করবি না।
-তোর বিয়ের কথা হচ্ছে আর তুই জানিস না? এটা কী হাস্যকর কথা নয়?
-তোর কাছে মনে হতে পারে।
-সেদিন না তুই-ই বললি সহেলি তোকেই পছন্দ করে?
-সেটা আমার মনের কথা ছিল না।
-কী বলছিস?
-হ্যাঁ, আমাকে তুই আজও চিনতে পারিসনি। তুই সহেলিকে ভালোবাসিস এ কথা জানার পর আমি কি সত্যি সত্যি সহেলির দিকে হাত বাড়াতে পারি?
-তাহলে?
-যা দেখেছিস, শুনেছিস সবই ভুল, মিথ্যে।
-তাহলে এখন আমি কী করব? চাচা যে বলেছেনÑতোর গার্ডিয়ানদের সঙ্গে কথা বলতে।
-তুই চুপ করে থাক। চাচা জিজ্ঞেস করলে বলবি এই যে করছি চাচা।
-আমি মিথ্যে বলতে পারব না। আমি মনে করি সহেলি তার যোগ্য পাত্রের কাছেই যাচ্ছে।
-যা, বাজে বকিস না।
-পাত্র সিলিকশনে চাচা ভুল করেননি। তুই ভালো ছাত্র। আমার চেয়ে অনেক স¥ার্ট। পরিবারের অবস্থাও ভালো। সব দিকের বিবেচনায় আমি তো একটা ফকিরনি।
-না না, সহেলি তোর। সহেলিকে তোর হাতে তুলে দেয়ার দায়িত্ব আমার।
-তুই আমাকে বোকা বানাতে চেষ্টা করছিস? যিনি মেয়ের বাবা তিনি বলছেন, তুই তার হবু জামাই। যে কিনা পাত্রি সে নিজে বলছে সে তোকে পছন্দ করে। আর আমি কিনা বুক বাধব তোর কথায়।
-আমি ছাড়া তোর সামনে এখন যে আর কোনো আশার আলো নেই।
-কিন্তু এখন তুই আমার সামনে শুধুই কুয়াশা। ধোঁয়া, ধোঁয়া, ধোঁয়া।
সিরাজ কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে মিরাজের মুখের দিকে। তার মনে হচ্ছে, ভেতরে ভেতরে মিরাজ প্রচণ্ড রকম কাঁদছে।

(নয়)

ক’দিন সহেলি জয়ের একটা নেশায় পেয়ে বসেছিল সিরাজকে। নেশাটা ক্রমশ সহেলির প্রতি ভালোবাসায় পরিণত হয়েছিল। এটাই বোধহয় নিয়ম, প্রেম প্রেম খেলা থেকে প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু এখন বন্ধুর জন্য নেশাটা ত্যাগ করতে নিজেকে সে প্রস্তত করে। কিন্তু মিরাজও শক্ত হৃদয়। সেও বন্ধুর কাছে হার মানতে রাজি নয়। সহেলি প্রসঙ্গে একটা কথাও বলে না। ক’দিন ধরে তারা দু’জনই সহেলিকে পড়াতে যাচ্ছে না। এই সুযোগে সিরাজ তাকে খুঁচা দেয়।
-কীরে সহেলিকে পড়াতে যাবি না?
-ভাবছি।
-কী ভাবছিস?
-যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা? নেশা বলিস আর মোহ বলিস সবই তো কেটে গেছে।
-তাই নাকি? সহেলির প্রতি তোর শুধু মোহ ছিল? ভেবে বলছিস তো?
-কী জানি? হয়তো....
-হয়তো বলছিস কেন? তোর পছন্দ নিয়ে, তোর ভালোবাসা নিয়ে তোর মনে সন্দেহ ছিল? অথচ সহেলি নিজের মুখে বলেছে, সে তোকে ভালোবাসে।
-আর আমাকে বলেছে সে তোকে ভালোবাসে।
-তাই নাকি?
-তাহলে তো সহেলিকেই বলতে হয়-এ হেঁয়ালির নিষ্পত্তি করতে।
-না, দয়া করে এখনই তা করিস না। তাকে আরও সময় দে।
-আর তোর এ কথাই প্রমাণ করে তুই সহেলির প্রতি কত সহমর্মী।
-আমার জীবনে যে সহেলিই প্রথম। প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল : ও আমার জন্মজন্মাত্বের পরিচিত।
-বা! কবিরা বলার সময় কত বেশি বলে। বাস্তবে তারা কতটা স্বার্থপর হয়। না হলে নিজের মনকে তারা সন্দেহ করে?
-সন্দেহ, অন্তর্দ্বন্দ¡, টানাপোড়েন এসবই তো কবির সৃষ্টির পেছনে শক্তি যোগায়।
-ও সহেলিকে তোর ভালো লাগা, ভালোবাসা শুধুই কবিতা লেখার জন্য?
-আমি আসলে ঠিক এ কথাটাই বলতে চাইছি না।
-তাহলে সহেলির ব্যাপারে তুই এতটা অপোসকামী হয়ে গেছিস কেন?  খুব ভেবে চিন্তে উত্তর দে। হিপোক্রেটদের আমার একদম পছন্দ না।
-তুই আমাকে হিপোক্রেট বলছিস?
-বলতে বাধ্য হচ্ছি।
-আমি যদি বলি, এই সুযোগে তুই মহামানুষ সাজার চেষ্টা করছিস।
-মানে?
-খুব সহজ। তুই চাইছিস সহেলিকে তার পরিবারের বিরুদ্ধে, এমনকি তোর নিজেরও মনের বিরুদ্ধে আমার হাতে তুলে দিতে।
-এতে মহামানুষ সাজার কী দেখলি। বড়জোর তুই এখানে দেখতে পারিস-বন্ধুর জন্য বন্ধুর ত্যাগ। এক বন্ধুর ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আরেক বন্ধু তার ভালোবাসাকে উৎসর্গ করে দিচ্ছে।
-এটাই তোর মহামানুষ সাজার চেষ্টা।
-সব ভালো কাজের যদি এমন ব্যাখ্যা করিস তাহলে তো ভবিষ্যতে মানুষ ভালো কাজ করবে না। বন্ধুর জন্য ত্যাগ করবে না। তোর জন্য আমি কী করতে পারি ওটা দেখানোর সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
-ঠিক আছে এটা দেখার অপেক্ষাতেই থাকলাম।


(দশ)

পরদিন সকালে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে মিরাজের। স্বপ্নটা এ রকম : ব্যাগ হাতে নিয়ে সে ময়মনসিংহ রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জন্য অপক্ষো করছে। হঠাৎ একটা ছন্নছাড়া লোক তার ব্যাগটা ছোঁ মেরে নিয়ে দৌড় লাগায়। সেও লোকটার পেছনে দৌড়াতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে। আমার ব্যাগ! আমার ব্যাগ! সামনের ক’টা লোক ব্যাগসহ ছন্নছাড়া লোকটাকে ধরে মারতে থাকে। মিরাজ কাছে গিয়ে দেখে লোকটা আর কেউ নয় তারই বন্ধু সিরাজ। সে তখন হতবাক হয়ে সিরাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর সিরাজ তখন চিৎকার করে বলতে থাকে ‘‘এই লোকটার জন্যই আজ আমার এ অবস্থা। আপনারা একেও ধরুন, মারুন।’’ সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যায় তার। কিন্তু সিরাজ পাশে নেই। রাতে একটু অগে পরে হলেও দুজনই শুয়েছিল। মিরাজের ঠিক মনে আছে, সিরাজ কেমন ছটফট করছিল। সে লাফ দিয়ে ওঠে বসে। জোরে জোরে ডেকে ওঠে, সিরাজ! সিরাজ!!
সিরাজ খুব ভোরে তার ব্যাগটা নিয়ে নিঃশব্দে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। মিরাজের যখন ঘুম ভেঙেছে সিরাজ তখন চলন্ত আন্তঃনগর ট্রেনের জানালায় বসে নিজের দুরবস্থার কথা ভাবছে। মিরাজ মোবাইলে ফোন দেয়। কিন্তু সংযোগ পাচ্ছে না। নেটওয়ার্ক উত্তর দিচ্ছে : এই মুহূর্তে আপনার কাক্সিক্ষত না¤¦ারে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। একটু পরে আবার চেষ্টা করুন।
বড় অস্থির হয়ে পড়ে মিরাজ। তার বার বার মনে হচ্ছে, সিরাজকে সে এতটা অবিশ্বাস না করলেও পারত। বিপদের আশঙ্কায় সে সহেলিকেও বিষয়টা জানিয়ে রাখতে চাচ্ছে। কিন্তু এত সকালে সহেলিকে ফোন করা কিংবা ডেকে আনা ভালো দেখাবে না। তাছাড়া, গতকালের চাচার ঘোষণার পর পরই সিরাজ হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। এখন সিরাজ যদি  কিছু একটা করে বসে এর দায় তার ঘাড়েই পড়বে। সে অস্থিরভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে আর রিং দিতে থাকে সিরাজের না¤¦রে। প্রতিবারই একই নেটওয়ার্ক উত্তর : এই মুহূর্তে আপনার কাক্সিক্ষত না¤¦ারে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। একটু পরে আবার চেষ্টা করুন।
-‘‘সিরাজ কোথায় যেতে পারে? না বলে যাবে কেন? আমি কি তার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি?’’ মিরাজ গতকালের সব ঘটনা আবার স¥ৃতি সাঁতরে তুলে আনে। ঠিক তখনই সহেলি ওপরে আসে।
-সহেলি এসো! এসো! আমি তোমাকেই চাচ্ছিলাম। আমার খুব বিপদ।
মিরাজের অস্থিরতা দেখে সহেলি অবাক হয়। সেদিনের রাতের কথা মনে পড়ে। কত সহজেই মিরাজ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এটা কি তার কোনো অসুখ?
-কী হয়েছে? আপনাকে এত অস্থির লাগছে কেন?
-সকালে ঘুম ভেঙে দেখি সিরাজ নেই।
-মানে?
-মানে ঘরে নেই। কোথায় গেছে কিছু বলে যায়নি।
- কোথাও কিছু লিখে রেখে গেছে কিনা।
-দেখলাম তো পেলাম না।
- কোথায় দেখেছেন? টেবিলের ওপর, আপনার খাতার মধ্যে, শার্টের পকেটে, ড্রয়ারের ভেতর?
- দেখেছি পাইনি। ও যদি কিছু একটা করে বসে?
-আত্মহত্যার কথা ভাবছেন?
-হ্যাঁ, আজকাল পত্রিকায় দেখি কত তুচ্ছ কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে।
-তুচ্ছ কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে না। আপনার দেখাটা ভুল। পত্রিকায় সব কথা ছাপা হয় না।
-আমি খুব ভয় পাচ্ছি।
-অস্থির হবেন না। দেখুন ব্যাগট্যাগ নিয়ে গেছে কিনা?
-হ্যাঁ, ব্যাগ নিয়ে গেছে।
-তাহলে বাড়ি চলে গেছে।
-কিন্তু এভাবে কিছু না বলে? রাত থাকতে?
-আপনি কি কোনো কারণে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন?
-না, তেমন না। কিছু কথার কাটাকাটি হয়েছিল। এই যেমনটি প্রতিদিন হয়।
-কী বিষয়ে?
-তোমাকে নিয়ে।
-আমাকে নিয়ে? ও গতকাল আব্বা ওই কথা বলার পর আপনি তাকে...
-বিশ্বাসঘাতক বলেছি।
-কী বিশ্বাসঘাতকতা করল? মিরাজ ভাই আমি আপনাকে অনেক বড় মনের একজন মানুষ ভেবেছিলাম।
-কিন্তু চাচা ও কথা বলার পর আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মাথা ঠিক ছিল না।
-আমার মতামত আপনি নিতে পারতেন? আব্বার ওই কথার জন্য বহু বছরের পুরনো বন্ধুর সঙ্গে আপনি খারাপ ব্যবহার করতে পারেন না। তাও আবার একটা মেয়ের জন্য?
-একটা মেয়ে নয়, তোমার জন্য। আমার ভালোবাসার জন্য।
-ওই হলো।
-আমার খুব খারাপ লাগছে। এখন আমি বুঝতে পারছি বেশ কিছুদিন ধরেই তোমার জন্য আমি ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে এসেছি। ওর সবকিছুতেই ভুল ধরেছি।
-তিনিও কি আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন?
-না। বেশিরভাগ সময় ও হাসত। কী ভেবে হাসত আমি জানি না।
-আপনার পাগলামি দেখে। আপনার ব্যবহারে আমি হতাশ।
-আমি সবসময় মনে করতাম ও তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে। আমার চেয়ে ওর যোগ্যতা অনেক বেশি।
সহেলি মিরাজের একটা হাত ধরে বলে এখানে বসুন। আর অস্থির হবেন না। ভুল যা করার তো করেই ফেলেছেন। তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেননি।
-হ্যাঁ, সত্যি বড় ভুল হয়ে গেছে।
-মোবাইলে ফোন দিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, বন্ধ পাচ্ছি।
-ঠিক আছে। আমিই তার সঙ্গে কথা বলব।
-আমি এখন কী করব?
-আমার হাত ধরে চুপচাপ বসে থাকুন। আর সাহস থাকে তো আমার চোখের দিকে তাকান। আমার জন্যই যখন এমনটি করেছেন। সহেলি হাসে।
-তুমি ঠাট্টা করছ?
-মোটেই না।
-সিরাজের জন্য তোমার খারাপ লাগছে না?
-অবশ্যই খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সিরাজ ভাই খারাপ কিছু করবে না। যেখানে যাক ভালো থাকবে। একদিক থেকে আমি বেশ খুশি যে আপনাকে একাকি পাচ্ছি। কিছু সময়ের জন্য হলেও বই থেকে মুখ তুলেছেন।
-সহেলি!
-হ্যাঁ, শুনে রাখুন আমি আপনাকেই পছন্দ করি, ভালো....
-বলো! বলো!
-ভালোবাসি।
-কিন্তু সে রাতে যে বললে।
-মনের কথা ছিল না। আপনাকে পরীক্ষা করেছিলাম। যখন দেখলাম আমার কথা শুনে আপনি অসুস্থ হয়ে গেছেন, তখন বুঝলাম আপনি আমাকে সত্যি ভালোবাসেন। আমি চাই আপনি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসুন।
-আর তুমি?
-গতকাল আব্বার কথা শোনার পর পরই আমি বুঝতে পারি আমি সিরাজ ভাইকে নয়, আপনাকে ভালোবাসি। আম্মাকে আমি আমার মনে কথা মা জানিয়ে দিয়েছি।
-তিনি কী বলেছেন?
-বলেছেন, পাগলি।

(এগারো)

সিরাজ ফোন বন্ধ করে দিয়েছিল। দুপুরে বাড়ি পৌঁছে। গোসল করে খেয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম না আসায় দাদুর সঙ্গে গ্রামের হাটে চলে যায়। ওখানে জলিলের সঙ্গে দেখা হয়। জলিলকে সে জড়িয়ে ধরে। চা খাওয়ায়। অতীতে যে বহুদিন কথা বলেনি সে প্রসঙ্গে একবারও তুলেনি। জলিলও খুশি বন্ধুর এমন ব্যবহারে। মিরাজের কথা জানতে চায়। সিরাজ বলে, মিরাজ খুব লাখি। সে ঢাকাতেই আছে। বড় লোকের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে প্রেম। মেয়ে তো নয় যেন ডানাকাটা পরী। মোবাইল ফোনের মেমোরিতে রাখা সহেলির ছবি দেখায়। সন্ধ্যের পর দাদুর সঙ্গে একই রিকশায় বাড়ি ফেরে। চাঁদনি রাত। বাড়ির সামনের পাকা সড়কের সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে দাদুকে সে সব কথা খুলে বলে এবং পরামর্শ চায় পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে।
দাদু মফঃস্বলের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থেকে রিটায়ার। খেলোয়াড়, নাট্যকার ও স্বজ্জন হিসেবে গ্রামে বেশ সুনাম তার। একজন রসিক মানুষও তিনি। প্রশ্ন করলেন:
-তোর মনের কথা বল। সহেলিকে কি তুইও পছন্দ করিস? ভালোবাসিস?
- যদি বলি ‘হ্যাঁ’।
-তাহলে বলব, যা জয়ী হ। যুদ্ধ আর প্রেমে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই। মেয়ের বাবা যেহেতু তোকে পছন্দ করে তোর জন্য পথ প্রশস্ত। মেয়ের যদি সামান্য অমতও থাকে বিয়ের পর তা কেটে যাবে।
-কিন্তু মিরাজ যে কষ্ট পাবে?
-বন্ধুর জন্য ত্যাগ করতে চাস?
-হ্যাঁ, মিরাজের জন্য কিছু করার এটাই উপযুক্ত সময় দাদু।
-তাহলে তো তোর কষ্ট হবে।
-হোক, মেনে নেবো। শুধু ত্যাগ নয়, আমি তাকে সহযোগিতা করতে চাই।
-তাহলে আর কোনোদিন সহেলিদের ওখানে যাবি না। তাহলেই অনেক সহযোগিতা করা হবে।
-ঠিক আছে দাদু আমি আর কোনোদিন ওদের ওখানে যাবো না।
রাত দুটোর ওপরে বাজে। সিরাজের ঘুম আসছে না। সে ঘর ছেড়ে পুকুর ঘাটে চলে যায়। ওখানে ঘাটের সিঁড়িতে বসে মোবাইল অন করে গান শোনার জন্য। গান বাজছে : আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায় মনে পড়ে মোরে প্রিয় চাঁদ হয়ে রব আকাশের গায় বাতায়ন খুলে দিও...
সহেলির ফোন। সিরাজ ধরে না। আবার রিং বাজে। সিরাজ ধরে না। আবার রিং বাজে। এবার ধরে।
-কী হলো ধরছেন না যে? ঘুমোচ্ছেন?
-না, গান শুনছি।
-আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়....?
-হ্যাঁ।
-বা! আমার সঙ্গে মিলে গেছে। আপনি এখন কোথায়?
-আকাশে।
-মানে?
-তোমার ঘরের পূবের দিকের জানালাটা খুলে পাশে দাঁড়াও। দেখবে গোলকার চাঁদের পাশে আমি আছি এক খণ্ড কালো মেঘ।
-চাঁদকে কি গ্রাস করতে চান?
-না, বৃষ্টি দিয়ে উত্তপ্ত পৃথিবীকে শীতল করতে চাই।
-দাঁড়ান, দঁড়ান আমিও ছাদে আসছি।
-কী বলছ, এত রাতে ছাদে আসবে?
-এত রাত তো কী হয়েছে। নিজের ঘরের ছাদ বলে কথা।
-হ্যাঁ, তোমার তো একটা ঘর আছে।
-এ ঘর আমার না। আমার বাবার। এরপর ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে কে জানে? এখন বলুন এই মুহূর্তে আপনি কোথায় আছেন?
-বললাম না আকাশে।
-হেঁলালি ছাড়ুন। আপনার জন্য আমরা দু’জন মানুষ সারাদিন টান টান উত্তেজনায় কাটিয়েছি।
-কেন, কী হয়েছে?
-কী হয়নি তাই বলুন। মিরাজের বন্ধু সিরাজ তাকে কিছু না বলে রাতের অন্ধকারে কোথায় যে চলে গেছে। এরপর মিরাজের কী কান্না।
-ভালো করে দেখেছিলে চোখে পানি ছিল কিনা।
-ঠাট্টা ছাড়ুন। কোথায় আছেন এখনই বলুন। চোরের মতো পালালেন কেন? সাহস ছিল না সবকিছু মোকাবেলা করার?
-এ্যাই, কথা সাবধানে বলো। আমি শুধু তোমার ভাড়াটে ভাই নই....
-সরি, প্রিয় শিক্ষকও। না, না আরও অনেক কিছু....
-যেমন....
-বন্ধু।
-বন্ধু শব্দটি দিয়ে আজকাল আর কাছের কাউকে বোঝায় না।
-তবু বন্ধু শব্দটিই আমার কাছে এখনো সবচেয়ে প্রিয়। কারণ যখন বন্ধু হিসেবে কাউকে ভাবি তখন শুধু আপনাকে পাই। আর.... আর আপনি যে আমার মিরাজের ছোট বেলার বন্ধু।
-বা! ভালো বলেছ, তোমার মিরাজ।
-আপনার কষ্ট হচ্ছে না? হিংসা, ঘৃণা এসব হচ্ছে না?
-না। আমি যদি এ মুহূর্তে তোমার কাছে থাকতাম তাহলে তুমি ঠিক দেখতে পেতে ওসবের কোনো চিহ্ন আমার চোখে মুখে নেই। তাইতো কল্পনায় আকাশের মেঘে ঠাঁই করে নিয়েছি-যাতে সবাইকে পাই, কাউকে বঞ্চিত না করে।
-আপনি মিরাজের চেয়ে অনেক বড় কবি। কিন্তু আমি যে ওকেই ভালোবাসি। আমার আব্বা আপনাকে ঠিক চিনেছিলেন।
-উনাকে ধন্যবাদ। যথাসময়ে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন। পালানোর সময় ছিল। আরও দেরিতে হলে অনেক বেশি কষ্ট হতো। হয়তো কষ্টে কষ্টে নষ্ট হয়ে যেতাম। আচ্ছা, তুমি প্রথম কখন জানলে যে, তুমি মিরাজকেই ভালোবাসো।
-গতকাল আব্বার ঘোষণার পর।
-ইন্টেলিজেন্ট গার্ল। সত্য বলতে আমিও।
-এ জন্যই কি...?
-হ্যাঁ, চোরের মতো...
-না, চোরের মতো নয়। নিষ্ঠুরের মতো।
-মিরাজের জন্য আমাকে আমার আব্বার মতে বিরুদ্ধে যেতে হচ্ছে।
-ক্ষতি কি ভালোবাসার জন্য যাচ্ছ।
-কিন্তু
-কিন্তুর কিছু নেই। আমি তোমার জীবনে শুধু একটা কালো ছায়া।
-কালো না, আলোর ছায়া। মায়া।
-আমি চাই না আর কোনোদিন আমাদের দেখা হোক।
-এমন নিষ্ঠুর কেন হচ্ছেন?
-তোমার মঙ্গলের জন্য। মিরাজ তোমার পাশে আমাকে দেখলে খুব ঘাবরে যাবে। 
-বিয়ের পরও?
-হ্যাঁ, আমি অন্তত তাই মনে করি।
-কিন্তু আমি যে ভুলতে পারব না।
-পারবে। চোখের আড়ালে যাওয়ার মানেই তো মনের আড়ালে চলে যাওয়া। অবশ্য আজকাল একেবারে মনের আড়ালে যাবার সত্যি উপায় নেই। ব্লগ, টুইটার, মাইস্পেস, গুগল+, ফেসবুক আছে, খুঁজলেই বন্ধুর দেখা মেলে।
-আমি সত্যি সত্যি ভুলতে পারব না। কারণ আপনার শিক্ষা রইল আমার মাঝে। জীবন সংগ্রামের পথে আমি তা থেকে যে আলো পাবো।
-মিরাজকে খুব ভালোবেসো। ওর চোখের আড়ালে যেও না। ও বড় আবেগ প্রবণ।
-আপনার পরামর্শ আমার মনে থাকবে। আমাদের বিয়েতে আসবেন না?
-বলতে পারি না। তোমরাই হয়তো দাওয়াত করবে না। হাঃ হাঃ আহ!
হাসতে হাসতে সিরাজ কেমন আর্তনাদ করে উঠল। ভয়ানক বিপদে পড়া মানুষের কণ্ঠের মতো শোনাল তার কণ্ঠ।
-কী হলো! সিরাজ ভাই! সিরাজ ভাই!
কিন্তু সিরাজের কণ্ঠ সে আর শুনতে পেলো না। তার মনে হলো অপর প্রান্তের জায়গাটায় একটা ঝড় ওঠেছে। গাছপালা ভেঙে পড়ছে। একসঙ্গে অনেক ঢেউ ভেঙে পড়ছে পাড়ে। পানি ছিটছে যাচ্ছে বহুদূর। মৃত্যুর আগে মানুষ যেমন গোঙায় এমন গোঙানির শব্দটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। সহেলি ভয়ে কথা বলতে পারছে না। তার মা এগিয়ে এলেন,
-কী অইলো এমন করতাছাছ ক্যায়া?
-মা, আমার মনে হয় সিরাজ ভাই হঠাৎ ভয়ানক কোনো বিপদে পড়ে গেছেন। মনে হয় কেউ তাকে মেরে ফেলেছে।
কী কছ দে তো ফোনটা আমার কাছে।
তিনি ফোনটা কানে ধরে রেখে বললেন,
-পানির শব্দটা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এত রাতে, সিরাজ পানির কাছে আইছিল ক্যায়া? যা, ঘরে যাই। এত রাইতে ছাদের ওপর আছি জানতে পারলে তর আব্বায় মাইরা ফালাইব।
-কিন্তু আমার মনডা যে কেমন করচ্ছে!
-আল্লাহ, আল্লাহ কর মা। সিরাজ কত ভালা একটা পোলা। এই মিরাজডার লাগিই ছেলেটা চইলা গেলো।
-মা!

( বারো)

খুব ভোরে সহেলি আর তার মা মিরাজের সঙ্গে দেখা করতে যায়। গিয়ে দেখে মিরাজ খুবই বিমর্ষ মনে শুয়ে আছে। কান্না কান্না ভাব। কিন্তু মিরাজ সকালবেলা শুয়ে থাকা স্বভাবের ছেলে নয়। নামাজ পড়েই রান্নায় লেগে যায় অথবা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
-কী অইলো শুয়া আছ যে, অসুখ করে নাই তো? সহেলির মা জানতে চাইলেন।
-না চাচী। রাত আড়াইটার দিকে একটা দুঃস্বপ্ন দেখার পর ঘুমোতে পারিনি।
-আড়াইটার দিকে ? কী দুঃস্বপ্ন মিরাজ ভাই?
-খুব খারাপ আমি বলতে পারব না।
-সিরাজ ভাইকে আপনি খুন করেছেন, এইতো?
-কী বলছ সহেলি? আমি কি তা করতে পারি?
-না, স্বপ্ন দেখেছেন।
-হ্যাঁ, ঠিক এরকমই একটা স্বপ্ন। তুমি কী করে জানলে?
-স্বপ্নটা যে আমিও দেখেছি। আচ্ছা, সিরাজ ভাইদের একটা পাকা ঘাট পুকুর আছে না?
-হ্যাঁ, পুকুরটা খুব আজুরে। সবাই বলে, ওই পুকুরে সাতটি টাকার মটকি আছে। মাঝে মধ্যে ওই মটকিগুলো পুকুরের পাড়ে ওঠে বসে থাকে। কেউ ধরলেই পানিতে নেমে যায়। কিন্তু লোকটা তার ধরা হাত আর ছাড়াতে পারে না। তিনচার দিন পর পাওয়া যায় তার লাশ।
-আচ্ছা সিরাজ ভাই কি ওই টাকার মটকি ধরতে পারেন?
-আরে না। সিরাজের এসব ব্যাপারে কোনো লোভ নেই। সে বলত, ওই টাকার মটকি সে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেছে। কিন্তু লোভ করেনি। আর তার দাদা নাকি মটকিগুলো জড়িয়ে ধরে বসে থেকেছেন কিছুই হয়নি। তবে লোভ করে যারা মটকি ধরতে গেছে তারাই মারা গেছে।
-তাহলে কী হতে পারে? আমার ধারণা গতরাতে সিরাজভাই মারা গেছেন।
-কী বলছ পাগলের মতো? আর তুমিই বা কী করে জানলে?
-তার মরণ আর্তনাদ যে আমি নিজের কানে শুনেছি।
-মানে, সিরাজের নাম্বারে তুমি ফোন দিয়েছিল?
-হ্যাঁ, আপনি দেননি?
-আমি সারাদিনই বন্ধ পেয়েছি।
-বন্ধ তো আমিও পেয়ছি কিন্তু রাতটা দুটোর পর হঠাৎ লাইন পেয়ে যাই। আড়াইটার দিকে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই তার ফোনটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। আমি তার আর্তনাদ শুনি।
-তুমি অহনি বাড়ি যাও মিরাজ। দেইখা আসো সিরাজ কেমন আছে? আহা, কত ভালা একটা পোলা!
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন চাচী। আমি এখনই যাচ্ছি।
-আপনি রেডি হন আমি ভাত নিয়ে আসছি। বলেই সহেলি নিচে নেমে যায়।
-আচ্ছা, তোমার এক চাচা নাকি খুব খারাপ ধরনের লোক? মানুষটানুষ খুন করে?
-চাচী! মিরাজের কণ্ঠেও এবার আর্তনাদ। ‘‘ আমার চাচার প্রসঙ্গ এখানে আসছে কেন চাচী?’’
-না বাবা, এমনেই কইলাম। মায়ের মন তো বুঝ না।
-আমার চাচা মানুষ খুন করে আপনাকে কে বলল?
-সহেলি।
-সহেলি!

 ॥ তেরো ॥

সহেলি নিচ থেকে ভাত নিয়ে এসে দেখে সিরাজ বেরিয়ে গেছে। ‘‘মা, সিরাজ ভাই কি চলে গেছে?’’
-হ। এইত তাড়াতাড়ি নামইয়া গেল।
-আপনে তারে কইলেন না আমি ভাত আনতে গেছি।
-আমি তো...
-মা, আপনি নিশ্চয়ই সিরাজ ভাইকে শক্ত কিছু বলেছেন। এটা কী করেননি মা, ভাড়া ভাত রেখে যেতে নেইÑআপনি জানেন না?
-সহেলি, সিরাজ পোলাডার লাগি আমার মাথাডা গোল্ডগোল অইয়া গেছে। আমার খালি মনে অইতাছে, মিরাজের লাগিই সিরাজ বিপদে পড়ছে। সিরাজ যেন আমার পেডের সন্তান।
-মা!
-হ, এই দেখ আমার কান্দন আইতাছে!
-মিরাজের লাগি আপনের খারাপ লাগে না?
-হ, অহন লাগতাছে। খালি মুখে পোলাডা বাইর অইয়া গেল। এইডা আমি কী করলাম।
-আপনে তাকে কী বলেছেন?
-কিছু না, খালি জিগাইছি, তার চাচার কথা। ওই যে, রাইতে তুই কইছলে, তার একটা চাচা আছে, মানুষ  খুন করে।
-মা, মিরাজকে এ কথা বলে আপনি আমার কত বড় ক্ষতি করছেনÑবুঝতে পারছেন না মা ! সে কাঁদতে কাঁদতে ভাতের থালা হাতে নিচে নেমে যায়। আর তার মা হতবম্ভের মতো ওই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকেন।

॥ চৌদ্দ ॥

মিরাজ সিরাজদের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। বাস থেকে নেমে রেল লাইন ধরে এতক্ষণই সে উর্ধ্বশ্বাসে হেঁটেছে। কিন্তু  বাড়ির যত কাছে আসছে তার পায়ের শক্তি তত কমছে। বাড়ি ভরা মানুষ। রেল লাইন থেকে সামনের গোপাট সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে কেউ বাড়ি অভিমুখে যাচ্ছে। আরও কাছে পৌঁছলে কিছু কিছু কান্নার শব্দ তার কানে আসছে। সে একজন লোককে থামালো, আচ্ছা ভাই! ওই বাড়িতে কী হয়েছে? অত লোক কেন দেখা যাচ্ছে?
-এই বাড়ির, আহা কত ভালা একটা ছেলে, শহরে থাকত। গতকাইল বাড়িত আইছে। রাইতে কারা যেন তারে মাইরা ফালাইছে।
-কী বলছেন, কারা মেরেছে?
-এইডা তো কইতে পারি না। কেউ বলতাছে মানুষে মারছে। কেউ বলতাছে আজরে মারছে। ত আমরা জানি তারার পুকুরডা যে আজইরা।
-মিরাজ ব্যাগ হাতে দৌড়াতে শুরু করে। সিরাজ! সিরাজ!! দোস্ত আমার।
-পুকুর পাড়েই সিরাজদের বাহির বাড়ির উঠুন। সারা গায়ের মানুষ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। শত শত লোক ভিড় করেছে সিরাজের লাশের পাশে। চারপাশে চলছে শোকের মাতম। ওইদিকে এলাকার পরিচিত গোর খোদকের সঙ্গে কিছু লোক বাঁশ কেটে তৈরি করছে খাইটা, চাটাই।
ভিড় ঠেলে মিরাজ একেবারে সামনে চলে আসে। ওখানে সবার মধ্যে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছেন সিরাজের দাদা। তিনি মিরাজকে দেখেই বলে উঠলেন, এই যে, এই ছেলেটার জন্যই আজ আমার সিরাজ মইরা গেল।
-হঁ দাদু, ঠিক কথাই কইছেন। আমার লাগিই সিরাজ মইরা গেল। আমিই তার মরনের লাগি দায়ী।
-ভিড়ের মধ্য কেউ একজন হঠাৎ বলে উঠল, এই তাহলে সেই কালপ্রিট! ধর শালারে।
-আরেকজন বলল, নিজের মুখেই ত স্বীকার করতাছে। ধর, ধর!
বাংলা মূল্লকের একটা চিরন্তন বৈশিষ্ট্য হলো-এরা হুজুকে মাতে। এদের প্রেম-ভালোবাসাও হুজুগে বাড়ে কমে। কখনো হুজুগ তাদের পাগল করে দেয়। উন্মত্ত হাতি বানিয়ে দেয়। ভালোমন্দের বিচার করার ক্ষমতা তখন তারা হারিয়ে ফেলে। তাই ধর, ধর বলতে যত দেরি হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষিপ্রতায় মানুষ মিরাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নিমিষে তার হাতের ব্যাগ ছিটকে কোথায় গিয়ে পড়ে। তার জামাকাপড়ের মতোই তোলা হয়ে উড়ে যায় তার হাত-পা-চোখ। সিরাজের দাদা লাফ দিয়ে এসে বুক আগলে দিতে চেয়েও পারেননি। চোখের পলকে যা ঘটার তাই ঘটে গেল। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত শকুন যেন মুহূর্তের মধ্যে ছিঁড়ে খেলো একটা মৃত গরু।





কোন মন্তব্য নেই :