বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১১

নির্মলেন্দু গুণের নিশিকাব্য


গ্রন্থ আলোচনা

নির্মলেন্দু গুণের নিশিকাব্য

গুণের নিশিকাব্য যেন এক নারী
কখনো দেশ সে, কখনো ঈশ্বরী
কখনো এসব নয়. নগরের নটী
স্রেফ কামদেবী, স্রেফ বাড়াবড়ি
.............................................................................
    নিশিকন্যা-নির্মলেন্দু গুণ প্রকাশক -একুশে বাংলা প্রকাশন, ঢাকা
প্রচ্ছদ-ধ্রুব এষ প্রকাশ কাল-বইমেলা-২০০৬
পৃষ্ঠা-৭৮ দাম-১০০ টাকা
........................................................................
নির্মলেন্দু গুণের অসামান্য কাব্যগ্রন্থ নিশিকাব্য৭৮ পৃষ্ঠার এ কাব্যগ্রন্থটিতে ছোট বড় ২৬০টি কবিতা (বা কবিতাংশ) স্থান পেয়েছে  কবি গুণের নিশিকাব্য যেন শচিন দেব বর্মনের সেই নিশি ভ্রমরাশিল্পী যাকে নিশিথে ফুলবনে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেনকল্পনা করে নেয়া যায় যে, এ গানটিতে শিল্পী রাতের একটি বিশেষ প্রহরে তাঁর একাকীত্বের জন্য প্রিয়ার সান্নিধ্য কামনা করেছেনআর কবি গুণের নিশিকাব্য যেন সেই ডাহুকী বর্ষার রাতে রাতভর যাকে ডেকে বেড়ায় ডাহুককখনো ভালেবাসার জন্য, কখনো একটু স্পর্শের জন্য রাতের পর রাত সে তার ব্যাকুলতা ছড়িয়ে দেয় আকাশে-বাতাসে
নির্মলেন্দু গুণ




বিষয় ও শিল্পমূল্যের বিচারে বাংলাদেশের আধুনিক কবিতা একটি বিশেষ মান সম্পন্নতায় পৌঁছেছে ষাটের দশকে (১৯৬০)আর সেই ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণের নামটি আলোচনায় আসতে পারে সর্বাগ্রেমি: গুণ অনবদ্য গদ্য লেখাতেও তার পারঙ্গমতা দেখিয়েছেনবেশ কটি ভ্রমণ কাহিনী এবং আমার ছেলেবেলা ও আমার কণ্ঠস্বর- এর প্রমাণআবার তাঁর কিছু প্রবন্ধ তাঁকে বিশিষ্ট প্রবন্ধ লেখকদের কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কিন্তু তাঁর প্রধান পরিচয় কবি হিসেবেআর তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় প্রেমপ্রেমের সঙ্গে আবার সমান্তরালভাবে আসে রাজনীতিতবে তাঁর প্রেম আর রাজনীতিতে কোনো দ্বন্দ্ব নেইক্ষেত্র বিশেষ একে অপরের পরিপূরকপ্রেমের সঙ্গে যৌনতাও তাঁর কবিতার আরেকটি অপরিহার্য অনুসঙ্গতাঁর প্রেমকে যৌনতা বা কাম থেকে পৃথক করা কঠিনতাঁর প্রেম যতটা মানসিক(প্ল্যাটোনিক) তার চেয়ে অনেক বেশি শারীরিকযেমন: কবিতা অমিমাংশিত রমণীর: আমার দৃষ্টি স্থির নারীর স্তনাগ্র চূড়ায় কিংবা ...তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীরঅবশ্য কবিতা অমিমাংশিত রমণীর প্রেম থেকে নিশিকাব্য-এর প্রেম অনেক বেশি পরিপক্কফলে তাঁর প্রেমে কাম আর শরীর অনেক বেশি জীবন ঘনিষ্ঠএ জন্য কখনো মনে হয়েছে কাব্যলক্ষ্মিকে বাদ তিনি দিয়ে কামদেবীর আরাধনা করছেন
কবি গুণের কিছু কিছু কবিতা বা কবিতাংশ প্রেমের বাণীরূপ লাভ করেছে, যেমন
...কাছে এসো প্রিয়তম, কাছে এসো প্রিয়া
বলে যেই নগ্ন হাতে ডেকেছি তোমাকে,
তুমি কেন পরিপূর্ণ হৃদয় সপিয়া
প্রেমের দুর্বল লোভে ঝাঁপ দিতে গেলে
যৌবনের অনির্বাণ অসীম অসীম চিতায়
কবিতা অমিমাংশিত রমণী (১৯৭৩)
নির্মলেন্দু গুণ শুধু একজন আবেগ সম্বল অসম্পূর্ণ কবি নন, সমাজ ও রাজনীতি সচেতন সম্পূর্ণ কবিআর এ জন্যই হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছেন, রাজনৈতিক আবেগের তোড়ে ভেসে গেলে না পাওয়া যাবে কাব্যলক্ষ্মির আশীর্বাদ, না পারা যাবে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাযেহেতু দিন দিন মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ছে, এটা স্পষ্ট যে, সমাজতন্ত্রের বুলি দিয়ে মানুষকে আর ঘায়েল করা যাবে নাজন্মগতভাবে না হলেও রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে ভাগ্য আর ভগবান-এ দু'য়ে কিছুটা অবিশ্বাস মি. গুণের মধ্যে ছিলকিন্তু খালেদা জিয়া যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন তিনি একটি পত্রিকার কলামে লিখলেন, ভাগ্য বলে সত্যি কিছু হয়তো আছেআর ওই যে বিশ্বাসে ফাঁটল ধরল তিনিও ঘুরে দাঁড়ালেন নিজের দিকেভাগ্যের চাকা কীভাবে ঘোরাতে হবে এ চিন্তায় বিভোর হলেনহয়তো তারই ফলশ্রুতি হিসেবে আজকের নতুন ধারার কাব্য মুঠোফোনের কাব্য, নিশিকাব্য আমরা পেলামনা হলে তাঁর পুরো দুটি কাব্যগ্রন্থটি কীভাবে রাজনীতির দুর্গন্ধ মুক্ত হয়ে শুধু বিশুদ্ধ প্রেম দিয়ে রচিত হতে পারে? তিনি নিশ্চিয়ই ধরে নিয়েছেন, কবিতাকে যথার্থ পণ্য করে তুলতে না পারলে জীবন থেমে যাবে অন্ধ বিশ্বাসের চোরাগলিতেহ্যাঁ, পাবলো নিরুদা, গর্সিয়া লোরকা কিংবা নাজিম হিকমাতদের দিন শেষসমাজতন্ত্রের ভরাডুবির সঙ্গে পূঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা এখন ঝাঁকিয়ে বসেছে মানুষের বিশ্বাসে ও নিঃশ্বসে| এখন মানুষকে অবরুদ্ধ কোনো চিন্তার দিকে ঠেলে দিয়ে না দিয়ে বরং তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আনন্দের গান গাওয়াই স্রেয়এবং নিজেকে তুলে ধরার সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পথ
এ কথা ঠিক যে, মুঠোফোনের কাব্য বা নিশিকাব্যের কবিতার আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট কবি গুণের একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবন নয়ইচ্ছে মতো স্তবকে কবিতা সাজিয়ে নির্মাণ করা এমনতরো কাব্যভাণ্ডার কখনো ধারণ করে একটিই মাত্র চিত্রকল্প কখনো বা ধারণ করে অসংখ্য পূর্ণাঙ্গ-অপূর্ণাঙ্গ চিত্রকল্পস্টাইলের দিক থেকে মওলানা রুমির মসনবী, সৈয়দ ইসমাইল সিরাজীর অনল প্রবাহ, গুণের নিশিকাব্য প্রায় একই ধরনের কাব্যগ্রন্থকবির যুগমনস্কতার সঙ্গে আধুনিক (বা সমসাময়িক) বিষয়ের যথার্থ বিন্যাস যখনই ঘটে কবিতা পাঠক প্রিয়তা পায়সবচেয়ে বড় কথা সময়ের দাবীরাষ্ট্র যখন দুঃসময়ে নিপতিত হয়, মানুষ যখন ক্ষুধা-যন্ত্রণায় কাতর থাকে, স্বৈরাচার আর দুর্নীতির অক্টোপাস যখন গ্রাস করতে উদ্ধত হয় রাষ্ট্রের সমূহ সম্ভবনাকে তখন কবিতায় মানুষ যে ভাষা ও বক্তব্য প্রত্যাশা করে ঠিক সুন্দর-স্বাভাবিক সময়ে এমনটি প্রত্যাশা করে নাসুখের দিনে সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় মানুষ মেতে উঠে সৃষ্টিশীল কাজেসুস্থ সন্তান, পুষ্ট শস্য এ সব যেমন সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী, এসবের জন্য নতুন বীজ যেমন জরুরি, তার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি নতুন উদ্দীপনাকবির উদ্দীপনা প্রধানত আসে বিকাশমান সুস্থ-সুন্দর সংস্কৃতির পাঠ থেকেকিংবা ধ্বংসের দ্বরাপ্রান্তে দাঁড়িয়েকবির কবিতা, লেখকের গল্প-উপন্যাস, শিল্পীর সংগীত, বিজ্ঞানের নতুন আবিস্কার এ সবই বাড়িয়ে দেয় সৃষ্টিশীলতার গতিকারণ প্রেম ও কামাকঙ্ক্ষা ছাড়া এবং এর জন্য ভেতরের তাগিদ ও আলোড়ন ছাড়া সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পায় নাপ্রকৃত নিবিড় বেদনা অনুভূত না হলে কেউই পায় না প্রসবের আনন্দএসব দিকের বিবেচনায় কবি গুণ সময়ের দাবীকে যথার্থই ধারণ করেছেন
নিশিকন্যার ২৬০ টি কবিতা (বা কবিতাংশ) মিলিয়ে আসলে একটিই কবিতা যার শিরোনাম গোধূলিপর্বগোধূলিপর্বের একেবারে শুরুতে তিনি লিখেছেন,
ভালোবাসা জমে জমে বুকের গভীরে
তৈরি হয়েছিল এক গোপন কয়লাখনি।...
তখনই বসন্তের এক পড়ন্ত বিকেলে,
তোমার সঙ্গে আমার হঠাৎ-দেখা
নিউ মার্কেটের কাছে, চাঁদনিচকের ভিড়ে।...
শুরুটা এমন সাদামাঠা আর অনুজ্জ্বল উচ্ছ্বাস দিয়ে যে অবাক হতে হয়অর্থাৎ কবি তাঁর প্রিয়ার সঙ্গে প্রথম দেখার সময়টা বর্ণনা করেছেন অন্য আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই, স্থানেরও বর্ণনা দিয়েছেন কিঞ্চিতকিন্তু কল্পনায় তিনি তাঁর মানস প্রিয়ার যত কাছাকাছি গেছেন, যত স্ফিত হয়েছে কাব্যের বুক, তত বেশি গভীর আর আবেগঘন হয়েছে ভাষাযেমন,
 চোখের সাদার মতো আমি তোমার কালোকে আছি ঘিরে,
তাইতো তুমি দেখতে পাও না তোমার আপন মানুষটিরে
আমার সাগর, আমার সমূদ্র, আমার সুনামি তুমি
আমি তোমার আশায় বাঁধিয়াছি ঘর তোমার সাগর তীরে
 প্রিয়ার ধ্যানে মগ্ন কবির ভাষা কোথাও কোথাও এমন আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছেছে যে, মনে হয় না কবি রক্তমাংসের কোনো মানুষকিন্তু যখন কাম-আগুনে পুড়ে তার মানস তখন তাঁর আরেক রূপআবার এমন কামভাবে বিলিন থেকেও তিনি তাঁর দেশের জন্য কাতরএর নাম রাজনীতি নয়, স্বদেশ প্রেমযেমন...
তুমি যে প্রেমের কূপে কামের আগুন জ্বালাইয়া দিলা,
সে-আগুনে জ্বলে-পুড়ে আমি হইলাম টেংরাটিলা। ... আহারে টিংরাটিলা
আগেই বলা হয়েছে, কাব্যের শুরুটা হয়েছে অনুজ্জ্বল উচ্ছ্বাস দিয়েআর এ জন্যই বোধহয় এর শেষটা এত বেশি আবেগঘনমিলনমুখী উচ্ছ্বাস ধীর লয়ে এগিয়েছে অনিশ্চয়তা দিকেতাইতো কবির হৃদয় সন্দহের দোলাচলে ভারাক্রান্তএকটা বিষয়, টোটাল কাব্যগ্রন্থে কবি তাঁর বক্তব্যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন নিআনন্দ আর উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি অনিশ্চিয়তার ইঙ্গিত, আবার মিলনের মধু শেষ না হতেই বিচ্ছেদের ভয়কবিতার শিরোনাম গোধূলিপর্ব হলেও সারারাত ধরেই চলে এর মিলমুখী আহাজারিযেমন-
আমি মিলেছি জলে-স্থলে, পদ্মাসনে
      উর্ধরেতা যোগীর শাসনে
      আমরা মিলেছি মুখোমুখি
      বৃক্ষাদিরুঢ়কে,
আমরা মিলেছি নিশি-তিলতণ্ডুলকে
এখানে কবি যে নিশির (বা রাতের) কথা বলেছেন এর কি আছে শুরু? নাকি আছে শেষ? এ নিশি চিরকালের, অনন্ত যৌবনা হয়ে ধরা দিয়েছে কবির কাব্যচিন্তায়সর্বকালে জন্য কবির নিশি তার রূপে কামনার বহ্নি জ্বেলে রাখে

আলোচনা: গাজী সাইফুল ইসলাম               

কোন মন্তব্য নেই :