বৃহস্পতিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশী ঔপন্যাসিক আবদুন্‌ নূরের সাক্ষাতকার

আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশী ঔপন্যাসিক আবদুন্‌ নূরের সাক্ষাতকার


শূন্যবৃত্ত খ্যাত আবদুন্‌ নূর ৬৬ বছরের জীবনে লিখেছেন মাত্র চারটি উপন্যাস (নন-ফিকশন) যেমন-প্যাগাসাস, শূন্যবৃত্ত (ইউপিএল-১৯৯০), উত্তরণ (ইউপিএল-২০০৩) বিচলিত সময় (ম্যাগনাম ওপাস-২০০৫/০৬) তাঁর উপন্যাস প্যাগাসাস রচিত হয়েছে গায়েনার পটভূমিতে ভারতীয়দের নিয়ে, শূন্যবৃত্ত শিকাগো ওয়াশিংটনের পটভূমিতে প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে, উত্তরণ আধুনিক ঢাকার পটভূমিতে আর বিচলিত সময়ের পটভূমি মোগল আমলের ঢাকা মি. নূরের জন্ম ১৯৩৯-এ, লেখালেখি শুরু ষাটের দশকে ১৯৬০ থেকে ২০০৫, ৪৫ বছরের লিখালেখির জীবনের শেষ বারো বছরে তিনি লিখেছেন তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস বিচলিত সময় বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ক্ষুদ্র পরিসরে তাঁর বিচলিত সময়কে মাস্টার পিস বললে বোধহয় বেশি বলা হবে না বলা আবশ্যক যে, এই লেখক তাঁর জীবনের বেশিরভাগটা সময় প্রবাসে থাকায় তাঁর অন্যান্য লেখা, যেমন- গল্প প্রবন্ধ, এগুলোর সঙ্গে আমাদের তেমন পরিচয় ঘটে নি 
আবদুন্‌ নূরের বিচলিত সময় উপন্যাসটি কোনো কাহিনী বিশেষ নয়, বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় উপন্যাস বিবৃত করেছে যারা আনিস সিদ্দিকীর মোগল হেরমের অন্তরালে পড়েছেন (যদিও এটা উপন্যাস নয়, ইতিহাস), যারা উইলিয়াম ডিমরিমপিলের হোহাইট মোগল পড়েছেন কিংবা দোমিনিকি লিপিয়ারের থাউজন্টেস সানস, তারা দেখেছেন মোগল ইতিহাস কতটা কৌতূহল উদ্দীপক হতে পারে আবদুন্‌ নূর তাঁর উপন্যাসের প্লট বেছে নিয়েছেন মোগল ইতিহাসেরই একটা অংশ থেকে উপন্যাসের রসদ সংগ্রহের জন্য তিনি ব্যাপকভাবে পাঠ করেছেন মোগল ইতিহাস গবেষণা চালিয়েছেন অহম ভাষা সমাজের ওপর জন্য তাঁকে অনেক লেখকের লেখা থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়েছে তাঁর আগের উপন্যাসগুলোতে এমন ব্যাপক গবেষণা সাধনার নজির আমরা দেখতে পাই না
বিচলিত সময় বিশাল আয়তনের উপন্যাস হলেও এর ভাষা অত্যন্ত প্রাঞ্জল, ছোট ছোট বাক্যে লেখক ইতিহাসকে গল্পাকারে  উপস্থাপন করে সবার জন্য সুখপাঠ্য করেছেন তাঁর ভাষার সরল মাধুর্যের জন্যই ইতহাসের গুরু গম্ভীর বিষয় উপন্যাসে সুখপাঠ্য হতে পেরেছে অবশ্য বিষয় হিসেবে ইতিহাস কিছুটা নিরস কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে, ইতিহাস মানেই মৃত মানুষ আর রাজা-বাদশাহর কাহিনী কাজেই এটা পড়ে কী হবে? অবস্থায় ইতিহাসের বিষয় উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়ে  যে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিতে পারে আব্দুন্‌ নূর তা দেখিয়েছেন
নারী-পুরুষের প্রেম উপাখ্যানের কিছু ব্যাখ্যা ছাড়া লেখক খুবই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন তাঁর কাহিনী বিন্যাসে কারণ. এতে রয়েছে পদে পদে বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা  যেহেতু রাজনীতি ধর্মীয় বিষয়াবলী বইটির পাতায় পাতায় এসেছে আলোচ্য বিষয় হয়ে, কাজেই লেখক এক মুহূর্তের জন্য অসতর্ক হলেও সামপ্রদায়িক লেখক হিসেবে তিনি আখ্যায়িত হতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেন নি মুসলমানদের (বা মোগলদের) বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে কিংবা পূজা-পার্বণে মুসলমানদের পাশাপাশি তিনি হিন্দু ধর্মেরও মহাত্ব প্রচার করেছেন সমান গুরুত্ব দিয়ে যদিও তাদের অনেকের (হিন্দু কিংবা মুসলমান) সে সময়কার ভুলগুলোও তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পিছ পা হন নি অর্থে, বঙ্কিমচন্দ্র মীর মোশাররফ হোসেনের পরে এবং তাঁদের তুলনায় ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস রচনায় আবদূন নূর আরও দক্ষতা আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছেন এসব দিক বিবেচনা করে তাঁর বিচলিত সময়কে আন্তর্জাতিক মানের উপন্যাস হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায় আমাদের সময়ের উপন্যাস সাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শওকত আলী অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ নাম তবে উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁরা কেউই অতীতের এমন বিশাল ক্যানভাস বেছে নেন নি বিশ্বের সেরা উপন্যাসগুলোর বেশিরভাগই কোনো না কোনো দেশের বিশেষ জাতি-গোষ্ঠির আত্মপচিয় আত্মবিশ্লেষণের ধ্রুবদি রূপ ছাড়া আর কিছুই না
বিচলিত সময় রচিত হয়েছে ১৬৬৯ সালের জুন থেকে ১৬৭৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই পনেরো মাসের বাংলার মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মুহাম্মদ আজম শাহের শাসনকালের চুম্বক অংশগুলো নিয়ে লেখকের উপস্থাপন জড়তামুক্ত রসোত্তীর্ণ হওয়ায় উপন্যাস পাঠে কালের খণ্ডকরণের ব্যাপারটি পাঠকের কাছে তেমন ধরা পড়ে না এখানে পাঠক দেখতে পাবেন সেই সময়ের বাঙালি সমাজের ক্রমবর্ধ্বমান আত্মচেতনে উন্মুখ মানুষদের মুখ আর কবি, শিল্পী মেহনতি মানুষ কীভাবে নিরন্তর চালিয়ে গেছেন তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম লেখকের আরেকটি বড় কৃতিত্ব হলো, হিস্ট্রি এজ ইট ইজ (History as it is) এই সূত্র তিনি মেনে চলেছেন উপন্যাসে কবি সৈয়দ জাফর, দেবদাসী নর্তকী রশমী, মসলিন শাড়ি বয়ন শিল্পী মা আমেনা বেগম, পূর্তগীজ কুঠিয়ালের স্ত্রী বাংলার মেয়ে মারিয়া, মসজিদের ইতিহাস অনুসন্ধানী ইমাম শামসুদ্দীনসহ আরও অনেক মহান চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়-যারা  বাংলার মানুষের আত্মপরিচয় নির্মাণে যুগ যুগ ধরে নজির হয়ে থাকবেন
বিচলিত সময়ের মতো বিশালাকৃতির (দুখণ্ডে মোট ৯১৬ পৃষ্ঠা ) উপন্যাস রচনা করা সত্যি দুরূহ কাজ একজন ফুলটাইম লেখেকের পক্ষেই কেবল এমন কাজে মনোনিবেশ করা সম্ভব কিন্তু ফুলটাইম লেখক না হয়েও আবদুন্‌ নূর তা পেরেছেন কারণ তিনি জাত লেখক বর্তমানে বিশ্ব সাহিত্যের বড় বড় লেখকগণ, বিশেষ করে, ইংরেজি ভাষায় যাঁরা লিখেন, অধিকাংশই ফুলটাইম লেখক কারণ, তাঁদের পক্ষে লেখালেখি করে সম্মানজনকভাবে জীবীকা নির্বাহ সম্ভব হচ্ছে যদিও বাংলা ভাষায় তা একেবারেই অকল্পনীয় ব্যাপার
সমপ্রতি বিচলিত সময়ের প্রকাশনা উৎসব উপলক্ষ্যে আব্দুন্‌ নূর বাংলাদেশে এসে মাস দেড়েক সময় অবস্থান করেন সময় তিনি পারিবারিক পরিমণ্ডলের বাইরে বিভিন্ন লেখক মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর লেখালেখি নিয়ে খোলামেলা মত বিনিময় করেন সময় একটি দৈনিক পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন-গাজী সাইফুল ইসলাম এই সাক্ষাৎকারে মি. নূরের তিনটি বইয়ের ওপর আলোচনা স্থান পেয়েছে উল্লেখ্য যে, মি. নূর তাঁর ব্যক্তি জীবন এবং আমেরিকায় তাঁর কর্মজীবন সম্পর্কে একবারেই কথা বলতে চান নি

আব্দুন্‌ নূরের সাক্ষাতকার

গাসাই: সাহিত্যে প্রবাসী লেখক একটা বড় ইস্যু প্রবাস জীবন কি আপনার লেখায় কোনো ছায়া ফেলেছে? সেটা পজেটিভ-নেগেটিভ যে অর্থেই হোক 
আব্দুন্‌ নূর: প্রথম কথা হচ্ছে আমি ওই প্রবাসী বা অভিসাসী শব্দটা স্বীকার করতে রাজি নই আর দেশের পরিসীমার বাইরে গেলেই যে আপনি অন্য দেশী হয়ে গেলেন ধরনের সীমাবদ্ধতা আমি স্বীকার করি না কয়েকটা কারণে, একটা হচ্ছে দেশ প্রেম, একটা ভাষার মানচিত্র একটা জাতিগত মানচিত্র আরেকটা রাজনীতিগত মানচিত্র বাংলাভাষার মানচিত্র যদি ধরে নিই আমরা তাহলে দেখব বিহার, উরিষ্যা, পশ্চিম বাংলা বাংলাদেশ, সবখানেই বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচিত হচ্ছে যারা বিহারে বসে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করছেন তাদের কি আপনি বিহারি লেখক বলবেন? নাকি অভিবাসী লেখক বলবেন? তাহলে বাংলা ভাষার লেখকরা যখন বাংলার বাইরে গিয়ে সাহিত্য রচনা করেন তখনই বা তাদের ধরনের লেবেল দিতে হবে কেন? এখন তো সারা বিশ্ব জুড়ে বাঙালিরা ছড়িয়ে গেছে, ৭০-৮০ বছর আগে এমনটি কল্পনা করা যেত না কিন্তু তখনও যারা দেশের বাইরে থেকে সাহিত্য রচনা করতেন, যেমন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বার্মায়, মাইকেল মধুসুদন দত্ত ফ্রান্সে থেকে সাহিত্য রচনা করেছেন আমরা কি তাদের প্রবাসী লেখক হিসেবে আখ্যায়িত করেছি কখনো? না করিনি সে জন্য গত পনেরো-বিশ বছর ধরে যে একটা কথা হচ্ছে, প্রবাসী লেখক, আমি এটা স্বীকার করি না আমার কাছে মনে হয় না লেখকদের জন্য এটা একটা মানসম্মত সীমা রেখা
গাসাই: আসলে প্রশ্নটা অন্যরকম  ছিল... আমি জানতে চেয়েছিলাম, যারা বিদেশে গিয়ে স্থিত হয়েছেন, স্বেচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক অথবা তিনি দেশ থেকে বিতাড়িতই হউন, কিন্তু সাহিত্য রচনা করছেন তার পিতৃভূমি নিয়েই, যেমন দাউদ হায়দার, নাজিম ওয়ালি, নাইপল, রমেশ গুনেসেগার এমনই আরও কত লেখক নিজের ভাষা বাদ দিয়ে ইংরেজিতে লিখছেন...
আ.নূর: না, নিজেকে আমি কখনো প্রবাসী লেখক মনে করি না আর নাইপলের কথা বলছেন? তাঁর পিতৃভূমি হলো ত্রিনিদাদ এই উপমহাদেশ থেকে ইংরেজরা যখন চলে যায়, একশো-দেড়শো বছর আগে, তখন ওরা অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে বিহার থেকে, প্রধানত পশ্চিম বাংলা থেকে, আর বাংলাদেশের খুলনা যশোর থেকে চুক্তিতে কুলি নিয়ে যায় সবচেয়ে বেশি কুলি যায় ক্যারাবিয়ান অঞ্চলগুলোতে কিন্তু ব্রিটিশরা পরে তাদের চুক্তির কথা মনে রাখে নি, ওসব লোকদের আর দেশে ফেরত পাঠায় নি ফলে বাধ্য হয়ে তারা ওসব অঞ্চলেই থেকে যায় বিয়ে করে সংসারী হয় নাইপলের বাবা ওইসব লোকেরই একজন আমার প্যাগাসাস উপন্যাসে আপনি তাদের (ভারতীদের) পাবেন সুদূর গায়েনার পটভূমিতে আর ত্রিনিদাদের যে অঞ্চলটিতে নাইপলদের বাস ওখানকার ভাষা কোনো সমৃদ্ধ ভাষা নয়, মিশ্র ভাষা বেশিরভাগ লোক কথ্য-মিশ্র ইংরেজিতে কথা বলে অবস্থায় নাইপলকে আত্মস্থ করতে হয়েছে ইংরেজি ভাষা পরে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে তাঁর সে ইংরেজি শক্তিশালী সংহত হয়েছে ফলে ইংরেজিকেই তিনি বেছে নিয়েছেন তাঁর মনের ভাব প্রকাশের জন্য
গাসাই: আপনার চারটি উপন্যাসের তিনটি আমি পড়েছি, শূন্যবৃত্ত, উত্তরণ বিচলিত সময় কোথাও মনে হয় নি লেখক আব্দুন্‌ নূরকে আমি খুঁজে পেয়েছি কী স্বদেশে কী প্রবাসে নাকি পাঠক হিসেবে আমি ব্যর্থ হয়েছি লেখককে খুঁজে পেতে?
আ.নূর: প্রশ্নটা আরও পরিস্কার করলে ভালো হয়             
গাসাই: অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি যে,  কোনো কোনো লেখকের বেলায় এমনটি ঘটে যে, তার সৃষ্ট চরিত্র তার নিজেরই চরিত্রের ছায়া...
আ.নূর: না, আমার উপন্যাসে আমাকে পাবেন না চারটি উপন্যাসের কোথাও আমি নেই সত্য বলতে, প্যাগাসাস গায়েনার পটভূমিতে ভারতীয়দের নিয়ে, শূন্যবৃত্ত শিকাগো ওয়াশিংটনের পটভূমিতে প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে, উত্তরণ আধুনিক ঢাকার পটভূমিতে আর বিচলিত সময়ের পটভূমি মোগল আমলের ঢাকা কাজেই কোনোটাতেই আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না
গাসাই: শূন্যবৃত্তের দুটি চরিত্র, আহমেদ নজীর অরুণ মিত্র আহমেদ নজীর বাংলাভাষার একজন লেখক, তাঁর একটি উপন্যাস, শ্বেতাঙ্গিনীর দেশে আমি পড়েছিলাম আর অরুণ মিত্র পশ্চিম বঙ্গের নামকরা কবি, কিছুদিন আগে তিনি মারা  গেছেন আপনি কি উপন্যাস রচনার সময় তাদের কারো নাম মনে রেখেছিলেন, যে কোনো কারণে...?
আ.নূর: না-না দুঃখিত তারা আমার সৃষ্ট চরিত্র, একান্তই কল্পিত নাম মিলে যাওয়ায় তাদের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে নাম একটা সমস্যা...
গাসাই: আসলে সমস্যা হিসেবে আমি নামের প্রসঙ্গটি তুলিনি কোনো কোনো লেখক তো তার পরিচিতদের মধ্যে থেকে, বন্ধুদের মধ্য থেকে চরিত্র বাছাই করেন কল্পনার গতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য...
আ.নূর: হ্যাঁ এটা ঠিক, এটা হয় আমার ক্ষেত্রে অবশ্য এমনটি কখনো করেছি বলে মনে হয় না
গাসাই: আপনি আপনার লেখক জীবনের শুরুটা একটু বলুন
আ.নূর: আমার লেখক জীবনের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল...? কী বলব...? তো বলা যায় হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিল খেলাঘর ছিল দৈনিক সংবাদের হাবীবুর রহমান ছিলেন ওখানে, তাকে আমরা ভাইয়া বলতাম তাঁর মতো আশ্চর্য দীপ্ত মানুষ আমার সামনে খুব কমই পড়েছে আরেকজন ছিলেন, ইত্তেফাকের কচিকাঁচার মেলার পরিচালক রুকুনূজ্জামান খান, আমরা তাঁকে দাদাভাই বলতাম, তিনিও ছিলেন অত্যন্ত দীপ্ত মানুষ ধরনের আরও কিছু দীপ্ত মানুষ যেমন আহসান হাবীব, মুহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, আনম বজলুর রশিদ, শামসুদ্‌দীন আবুল কালাম তাঁদের সাহচার্য আমার সাহিত্য রচনার প্রেরণা হয়ে থাকতে পারে আমি আর্মানিটোলা স্কুলে পড়তাম, বিতর্ক করতাম, বিতর্কগুলো রেডিওতে প্রচারিত হতো মনে পড়ছে বিকর্ত সংগঠনের প্রধান ছিলেন আতিকুল ইসলাম শামসুদ্‌দীন আবুল কালাম যিনি রোমে ছিলেন, দেশে থাকতে তাঁর সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতা ছিল আমার আমেরিকা যাবার পর বহুবার তিনি আমার এখানে এসেছেন আমিও গিয়েছি তাঁর কাছে একটা কথা, আমার হাতের লেখা খুবই খারাপ, এত খারাপ যে আমার স্ত্রীও পড়তে পারেন না তাছাড়া বাংলা বানানেও আমি কখনো তত যত্নবান নই লেখালেখির ক্ষেত্রে আগে লিখি পরে ঠিক করি বানান যা হোক, এজন্যই  শামসুদ্‌দীন আবুল কালাম একদিন আমাকে বলেছিলেন, আব্দুন্‌ নূর যদি বড় লেখক হতে চাও হাতের লেখা ভালো করো, বানানের প্রতি যত্নবান হও
শামসুদ্‌দীন আবুল কালাম অথবা শরফুল আলম তাদেরই কেউ একজন হয়তো আমাকে বলেছিল, রেডিওর জন্য একটি স্ক্রিপ্ট লিখে দিতে আমরা তখন ওটাকে বলতাম জীবনটিকা তখনকার দিনে ক্লাশ নাইনের একটি ছেলের পক্ষে ঢাকা রেডিওর জন্য স্ক্রিপ্ট লেখাটা একটা বড় ব্যাপার ছিল হাবীবুর রহমান বলতেন, ছোটদের জন্য লিখতে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক কী জানি নাম..., ফয়েজ আহমেদ, একজন অনন্য মানুষ বলতেন লেখা দেওয়ার জন্য বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ছিল, যেমন ফখরুজ্জামান চৌধুরী, মনসুর আহমদ (মারা গেছেন), এরপর মোস্তফা জামান আব্বাসী সেও লিখত, তো গানই করত বেশি তারা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবার গাফফার ভাই যা লিখতাম তাই ছেপে দিতেন মিল্লাতে ইত্তেফাকের রুকুনূজ্জামান খান খারাপ-ভালো জানতাম না ছেপে দিতেন মাঝেমধ্যে নিয়ে হাসিতামাশাও হতো একবার ফখরুজ্জামান চৌধুর আমাকে বেশ রাগিয়ে দিয়েছিল এখনও সে আমার একনিষ্ঠ বন্ধু একটা গল্প লিখলাম ছোটদের জন্য গল্পটার কাহিনী এখন আমার একদম মনে নেই, কিন্তু মনে আছে গল্পটা নিয়ে যে ঘটনাটা ঘটেছিল গল্পটার নাম ছিল কুকুর রুকুনূজ্জামান খান গল্পটা এমনভাবে ছাপলেন যে, গল্পের নামের সঙ্গে লেখকের নামের টাইপ সেটিং এমনভাবে হলো যাতে মনে হচ্ছিল, গল্পটার নাম কুকুর আব্দুর নূর আমি তো জানতামই না গল্পটা ছাপা হয়েছে
 বিকেলে রমনা রেস্টুরেন্টে গেলে ফখরুজ্জামান চৌধুরী বলতে লাগল, ওই কুকুর আব্দুর নূর এসছে, কুকুর আব্দুর নূর এসছে
আমি ভীষণ রেগে গেলাম, বললাম যে, ব্যাটা তুই আমাকে কুকুর বলে গাল দিচ্ছিস!
সে তখন হেসে বলল, গালি দিচ্ছি না তো-আমি বলছি তোর আর্টিক্যালের কথা আজই ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছে তারাই এভাবে ছেপেছে আমার কী দোষ?
যা হোক, দিন ছিল ওরকম, পড়তাম, লিখতাম, আড্ডা দিতাম
গাসাই: শূন্যবৃত্তে কোনো জীবন সংগ্রামের চিত্র নেই, যা আছে তাহলো জীবন যাপনের চিত্র
আ.নূর: আপনার দেখা হয়তো সত্য ওই উপন্যাসটাতে জীবন সংগ্রাম নয় জীবন যাপনের চিত্রই বেশি এর একটা কারণ হতে পারে যে, একটা চরিত্র যখন আমি দেখি সেটাকে ফলো করি, কোথা থেকে সে এলো সেটা আমি দেখতে চাই না দেখাতেও চেষ্টাও করি না যেমন নিলুফারের চরিত্র, দুটি সংস্কৃতির মধ্যে সে কীভাবে সামঞ্জস্য বিধান করেছে আমার কাছে সেটাই প্রধান কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার শৈশবের কথা বলা হয়েছে এটা একান্তই উপন্যাসের প্রয়োজনে
গাসাই: নিলুফারকে নিয়ে আরও কিছু প্রশ্ন আছে-পরে আসব প্রসঙ্গে এখন অন্য প্রশ্ন... আপনার তিনটি উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছে, আপনার লেখা সসব সময় একটা এলিট শ্রেণীকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে বিচলিত সময়ের কথা বাদ দিলে বিষয়টা আরও প্রকট আর আপনার চরিত্রদের সমাজে মদ, পার্টি, বল ডেন্স (যদিও শব্দটা আপনি ব্যবহার করে নি) অপরিহার্য
আ.নূর: হ্যাঁ, এগুলো আছে এলিট শ্রেণীর লোকদের কাছে মদ-পাটি... এগুলো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার  কিন্তু উপন্যাসে এগুলোর থাকার কারণ এই নয় যে আমি এগুলো খুব গ্রহণযোগ্য মনে করি আসলে আমি এগুলো ব্যবহার করেছি বিশেষ অর্থে বিশ্বাস মূল্যবোধ যে মানুষ হারায় সেটা দেখানোর জন্য
গাসাই: অর্থাৎ আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, ভিন্ন সভ্যতা সংস্কৃতিতে যাওয়ার পরে মানুষ পেছনের মূল্যবোধ বিশ্বাসকে ঝেড়ে ফেলে নতুন মূল্যবোধ বিশ্বাস গ্রহণ করে, সেটাকে সে আঁকড়ে ধরে?
আ.নূর: পরেরলোকে আমি মূল্যবোধই বলছিন না তো এগুলোকে যদি আমি মূল্যবোধ বলতাম তাহলে বইয়ের নাম শূন্যবৃত্ত রাখতাম না
বৃত্ত মানে কী একটি গোল চক্র তাহলে শূন্যবৃত্তের মানে দাঁড়ায় ফাঁকা গোলাকার চক্র অর্থাৎ এর মাঝে কোনো কিছু নেই আমি বলতে চেয়েছি, বৃত্তের চারপাশে আমার চরিত্ররা সবসময় ছুটছে একের পর এক ছুটছে কিন্তু ছোটার পেছনে তো মানুষের একটা উদ্দেশ্য থাকে আমরা ছুটছি কিছু পাবার জন্য অথবা কিছু দেবার জন্য আমাদের সন্তানের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য কিন্তু শূন্যবৃত্তের চরিত্ররা ছোটা শেষে যখন তাদের ডানপাশে তাকাচ্ছে দেখছে কিছু নেই বাম পাশে কিছু নেই সামনে পেছনে শূন্য এটা ঠিক ঘানি টানা বলদের মতো যার সামনে কোনো আশা থাকে না
গাসাই: শূন্যবৃত্ত প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯০ (ইউপিএল) সালে আমি বইটির আলোচনা সমালোচনা কোথাও দেখিনি এর সফলতা-দুর্বলতা নিয়েও কোনো বক্তব্য আমার সামনে পড়েনি
আ.নূর: এর একটা বড় কারণ হয়তো এই যে আমি বাইরে থাকি তো ওই সময় যারা ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন, তারা বলেছিলেন, আপনার উপন্যাসটা ভালো লেগেছে শুনে খুশি হয়েছিলাম কেউ বলেছিলেন, আমি লিখছি; কেউ বলেছিলেন, আমি লিখব কিন্তু পরে হয়তো আর কেউই লিখলেন না, লিখলেও আমার সামনে পড়েনি আসলে বাইরে থেকে এসব করানো কঠিন আর যদি বলেন পারসো করার একটা ব্যাপার আছে, আমি বলব, আমার পক্ষে তা করা একেবারেই অসম্ভব তাছাড়া, আমি মনে করি লেখক হিসেবে এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না লেখক হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো লেখা এবং একজন ভালো প্রকাশের মাধ্যমে তা তুলে ধরা আমি তা করেছি এরপর বাকি দায়িত্ব পাঠকের, সমালোচকের তারা যদি মনে করেন বইটা অন্যদেরও পড়া উচিত তখন তারা এটা নিয়ে লিখবেন, মতামত দেবেন
গাসাই: আমার মতে শূন্যবৃত্ত শুরু হয়েছে ১২২ পৃষ্ঠা থেকে আগের পৃষ্ঠাগুলো ছাড়াই উপন্যাস পরিপূর্ণ রূপ পেতে পারত কারণ নিলুফার শিকাগো এয়ারপোর্টে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১২২ পৃষ্ঠার পরে আর অরুণ মিত্রের দেখাও আমরা ওখানেই পেয়েছি
আ.নূর: পাঠক হিসেবে আপনার তা মনে হতে পারে, আপনার মতের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রথম দিকের ওই পৃষ্ঠাগুলোর প্রয়োজন আছে তবে হ্যাঁ, আপনি দাবী করতে পারেন যে, উপন্যাসের প্রকৃত নাট্যকীয়তা শুরু হয়েছে ১২২ পৃষ্ঠা থেকে
গাসাই: শূন্যবৃত্তে, একটা ভুল ব্যাখ্যা রয়েছে নিলুফারের স্বামীকে আপনি যেভাবে উপস্থাপন করেছেন আমার মতে সেটা এটা একটা ভুল প্রক্রিয়া এতে আপনাকে আমার একজন ইসরালী ইহুদি লেখকের থেকে ভিন্নতর কিছু মনে হয়নি যে মুসলিম সভ্যতা তথা রীতি নীতি পছন্দ করে না, বরং বিদ্বেষ পোষণ করে আর ওই পাশা খলিলের চরিত্র, খুবই সংক্ষিপ্ত হলেও, এর মাধ্যমে আপনি গোটা ধার্মিক মুসলমানদের খাটো করেছেন এবং দৃশ্যত তা করেছেন ইচ্ছাকৃতভাবে... প্রশ্ন হচ্ছে কেন, এর কী ব্যখ্যা রয়েছে আপনার কাছে?
আ.নূর: না, মুসলিম সভ্যতা তথা রীতিনীতি আমি মোটেই অপছন্দ করি না আর বিদ্বেষ পোসন করার তো প্রশ্নই উঠে না পাশা খলীল আমাদের সমাজে ছিল, একাত্তরে আমি যদিও দেশে ছিলাম না, কিন্তু তাদের কমকাণ্ড সম্পর্কে কী বলব... যথেষ্ট অবগত আছি এরা প্রকৃতপক্ষে না মুসলমান, না মানুষ এদের গোড়ামির জন্য সমাজ বিভ্রান্তিতে ভরে ওঠে আমার পাশা খলীল এমনই এজন মানুষ, একরাতেই সে প্রমাণ করেছে সহাবস্থানের উপযোগী সে নয়
গাসাই: কিন্তু এটা কি মানা যায়? আপনি বলছি না, উপন্যাসে আপনাকে খুব বেশি নৈতিকতার ধার ধারতে হবে (যদিও ভি.এস.নাইপল বলেছেন, নৈতিকতা ছাড়া আমি ভালো লেখক কল্পনা করতে পারি না) আপনি কি দেখেন নি আপনার নানা-দাদাদের সংসার করতে? আমি এর দ্বারা ওইসব মানুষকেই বোঝাচ্ছি যারা টুপি মাথায়, দাড়ি মুখে সংসার করেছেন - তাদের স্ত্রীরা পালায় নি তারা কি তাদের স্ত্রীদের আদর করত না?
আ.নূর: তাদের প্রসঙ্গ এখানে আসছে কেন?
গাসাই: জন্য যে আপনার উপস্থাপনে যে কৌশল অনুসৃত হয়েছে তাতে মনে হয়েছে সমাজের এই লেবাসের সব পাশা খলীলরাই এমন...
আ.নূর: এমন মনে করার কারণ নেই, সমাজের একজনকে দিয়ে আরেকজনকে বিচার করার পক্ষপাতি আমি নই
গাসাই: কারণ আপনার পাশা খলিল তো উচ্চ শিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে এসে ঘুমন্ত বউকে ধর্ষণ করেছে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নতুন বউ ঘরে রেখে সারারাতের জন্য নামাজ পড়তে চলে গেছে এটাও কেমন যেন মেনে নেয়া যায় না
আ.নূর: সমাজের এক একজন মানুষ এক একরকম তার চরিত্র তো তার আচরণেই মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠবে শিক্ষিত, ধার্মিক মানুষদের কি সমস্যা নেই? তারা কি পারিবারিক সামাজিক জীবনে সমস্যার কারণ হয় না? তার মানে কিন্তু এই নয় যে, একজনকে দিয়ে আরেকজনকে বিচার করতে হবে অথবা সবাইকে বিচার করতে হবে একজন ডাক্তার খারাপ বলে তো আর আমরা সব ডাক্তারকে খারাপ বলতে পারি না নাকি পারি? পাশা খলীলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য পাশা খলীলের মতো লোক আছে, এমন চরিত্রের দেখা আমরা পাই এখন আপনি যদি বলেন, একটি চরিত্র সমষ্টির প্রতিনিধিত্ব করছে, তাহলে বলব, আপনি ভুল করছেন হ্যাঁ, আপনার একটা খটকা লেগেছে, প্রশ্ন জেেেগছে আপনার মনে, আপনি আমার কাছে জানতে চাইতেই পারেন ব্যাপারে আমার আপত্তি নেই তবে আপনার চিন্তায় একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে কথা বলে রাখছি
গাসাই: কিন্তু পাশা খলীলের পরিসর খুবই সংক্ষিপ্ত... এমন সংক্ষিপ্ত পরিসরে একজনলোক সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা দেওয়া যায় না
আ.নূর: তার প্রয়োজন ছিল ওইটুকু পরিসরের...
গাসাই: আমি প্রশ্ন করছি আপনার উপস্থাপন কৌশল নিয়ে, তার সম্পর্কে আপনি এত কম কথা বললেন, এত কম ব্যাখ্যা দিলেন তার চারপাশের, ফলে কেন যেন মনে হয়, ব্যক্তি বিশেষকে আক্রমণ করার জন্য চরিত্রের অবতারণা করেছেন আপনি
আ.নূর: না, কোনো ব্যক্তি বিশেষের প্রতি বিদ্বেষ থেকে তাকে আক্রমণের কৌশল হিসেবে আমি চরিত্র সৃষ্টি করিনি সত্য বলতে কোনো চরিত্রই না
গাসাই: আপনি কেন বলেন নি, আপনার ওই নিলুফারেরই মেন্টাল চাহিদা বেশি ছিল, তার বাংলাদেশী জীবনের চেয়ে আমেরিকার ওই অধ্যাপকের আহ্বানে সাড়া দিতেই আগ্রহ ছিল বেশি
আ.নূর: হ্যাঁ, হতে পারে নিলুফারের মেন্টাল চাহিদা বেশি ছিল, বেশি না থাকলে সে পারত না নিজেকে নিয়ে আমেরিকায় একটি এয়ারপোর্টে হাজির হতে সে নিজেকে বিকাশ করতে চেয়েছে, সে চেয়েছে এমন পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে আপনি বেগম সাখাওয়াত হোসেনের কথা ভাবুন...
গাসাই: না-না, বেগম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে আপনি নিলুফারকে মিলাতে পারেন না


কোন মন্তব্য নেই :