বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১১

The War-a Kashmiri fiction by Cahman lal Hakhoo / Translated by gazi saiful islam

সাইফুল ইসলাম অনূদিত কাশ্মিরি গল্প
যুদ্ধ
মূল-চমন লাল হাক্কু
অনুবাদ-গাজী সাইফুল ইসলাম


বখতেয়ার সাধারণত সোয়া পাঁচটার দিকে তার অফিস ত্যাগ করে। অফিস ত্যাগ করার আগে সে তার টেবিল টা পরিষ্কার করে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাগজগুলো গুছিয়ে একপাশে রাখে। এরপর টাইপরাইটারটা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফাইলগুলো উঠিয়ে আলমারিতে তালাবদ্ধ করে এবং চাবিটা কোটের পকেটে রেখে দরজার দিকে পা বাড়ায়। ঠিক দরজায় দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে পুরো রুমটা আবার দেখে, সবকিছু ঠিকঠাক মতো আছে কিনা। যাত্রার মুহূর্তে সে তার পাজামার ভাঁজ ঠিক করতে করতে ইশারায় পিয়ন গোলাম রসুলকে ডাকে দরজা বন্ধ করতে। দরজা বন্ধ হয়ে গেলে সে একটা সিগারেট ধরায়। লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে। এভাবেই পঁচিশ বছর কেটেছে তার। সারা অফিসের মাত্র দু-তিনটি রুম ছাড়া বাকি সব রুমের খবর সে রাখে। ওইসব রুম প্রায়ই অন্ধকার থাকে। অন্ধকার এ অর্থে যে, দরজা জানালাগুলো সব সময় পর্দায় ঢাকা থাকে। বাহির থেকে কিছুই তেমন দেখা যায় না। বখতেয়ার জানে এই অন্ধকার রুমগুলোতেই অফিসের গুরুত্বপূর্ণ সকল প্রকার নীতি নির্ধারণ, বাজেট পাস, ছুটি-ছাটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ইত্যাদি হয়ে থাকে। বড় সাহেবরা এসব রুমে বসে অফিসিয়াল কাগজে দস্তখত করেন। গত পঁচিশ বছরই পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে জানালার আলোকিত কাঁচের ভেতর দিয়ে সে দেখেছে, বড় সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী মিস রীণা গভীর মনোযোগ দিয়ে ডিকটেশন নিচ্ছে। হালকা-পাতলা গড়নের রীণা গত কবছরের চাকরি জীবনে যেনো প্রতিদিনই যুবতী হয়েছে, উজ্জ্বলতা বেড়েছে তার ত্বকের। অবিবাহিত লাস্যময়ী রীণা সব বয়সের লোকদের কাছেই প্রিয় রমণী।
যখন সে চলতে শুরু করেছে কিছু একটাতে বাধা পেয়ে পেছনে ফিরে তাকায়। তার মনে হয়, অফিস ভবন, দরজা-জানালা, তার পায়ের নিচের মাটি সবকিছু কাঁপছে। গোলাম রসুল তখন স্টোভ পরিষ্কার করছিলো। বখতেয়ার দেখলো স্টোভের পাইপে তীব্র ঝাঁকুনি লাগছে। হঠা করেই তার মনে হলো, স্টোভের পাইপ আর আলমারিটা খুব কাছাকাছি হয়ে গেছে। পাইপটা আগে থেকেই টিনের শার্সি ছিদ্র করে ওপর থেকে জানালা দিয়ে ঘরে প্রবিষ্ট করানো ছিলো। সতর্কতার সঙ্গে সে আবার তাকালো, দেখলো আলমারিটা কাঁপছেই। সে তিনবার, আল্লাহু আকবার বলে বুকে ফুঁক দেয়। তার মনে হচ্ছে ভূমিকম্প। পিয়ন গোলাম রসুলও একদৃষ্টিতে আলমারিটার দিকে তাকিয়েছিলো। হঠা বিকট শব্দ। কিন্তু অন্যান্য আসবাবপত্র যেমন টেবিল-চেয়ার, ট্রে, কাপ-পিরিচ সবই আগের মতো স্থানে স্থানে রয়ে গেছে। তারা দুজনেই বিস্ময়ে বিমূঢ়। গোলাম রসুল মনে করছে ভূতের কাণ্ড এটা। অফিসের ওপর ভূত ভর করেছে। লোকেরা বলে, ভূতটা নাকি খুবই শক্তিশালী। এটা যৌবনের শুরুতেই কেড়ে নিয়েছে শংকরলালকে, বড় সাহেবকে জড়িয়েছে দুর্নীতির মামলায়। তারাই আবার বলে, এই শক্তির জন্যই মহিউদ্দিনের আজ এতো উন্নতি, প্রাচুর্য উপচে পড়ে তার বাড়ি-ঘরে।
কিন্তু বখতেয়ার ঝাঁকুনির কারণটা ইঁদুরের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। শ্যামা ম্যাগাজিনে সে পড়েছিলো ইঁদুরেরা দারুণ চালাক, এরা প্রায়ই এমন অঘটন ঘটায়। সে এগিয়ে গিয়ে আলমারির দরজাটা খুলতে যেনো টান দিয়েছে অমনি প্রলয়ংকরী শব্দে চারপাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে, যেন কামানের গর্জন। দরজার দুটো পাল্লাই ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে, ফাইলগুলো উড়ে এসে তার কপালে, নাকে-মুখে, এমন জোরে আঘাত করে যে সে জ্ঞান হারিয়ে স্টোভটার কাছেই গড়িয়ে পড়ে। জ্ঞান ফিরলে বখতেয়ার দেখে তার হাত পা জমে গেছে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার। অনেক চেষ্টায় হাতপা চালনা করতে পারলো কিন্তু কিছুই শুনতে পেলো না।
পরদিন বুনো আগুনের শিখার মতো সংবাদটা সারা অফিসে ছড়িয়ে পড়ে। সেক্শন অফিসার গোপিকৃষাণ ভাকিল সাহেব বললেন, কেইসটা অত্যন্ত জটিল। প্রধান কেরানি এ সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে জানালেন। আর মিস রীণা বিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতোই নিরবতা পালন করলেন।
গোলাম রসুল আর বখতেয়ার হাসপাতালে। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঘোষণা করেছেন, বখতেয়ারের চিকিৎসা এ শহরে হবে না, তাকে বোম্বে পাঠাতে হবে উন্নত চিকিসার জন্য। সে কথা বলতে পারে না শুনতে পায় না। দুর্ঘটনার পর একশ আশি দিন ধরে বখতেয়ার শয্যাশায়ী, ব্যস্ত দুনিয়ার সবধরনের কর্মতৎপরতা থেকে সে বিচ্ছিন্ন। তার সেলারি, সেভিংস বন্ধ, স্ত্রীর অলঙ্কারাদি চলে গেছে ডাক্তারের একাউন্টে। অফিসের ডেসপাস থেকে সিলমোহর দেয়া একটা চিঠি এসে তার সন্তানদের হাসি কেড়ে নিয়েছে, স্তব্ধ করে দিয়েছে স্ত্রীর মুখ। উঁচু ভল্টেজের একটি বাল্ব খুলে নেয়ার মতোই তার চোখের আলো কেড়ে নিয়েছে দুর্ঘটনা। বন্ধুরা ছেড়ে গেছে, পাওনাদারেরা তিরস্কার করছে। কাকদের সে তার শরীরের মাংস খেতে দিতে রাজি আছে যদি তারা বিনিময়ে তার অফিসের সংবাদ এনে দেয়।
তার বাবা সবসময় জিজ্ঞেস করেন, কেমন বোধ করছো বখতেয়ার? বখতেয়ার কিছুই বলতে পারে না, শুধু আরও কিছু শোনার জন্য কান পেতে রাখে। আগে তিনি প্রায়ই বলতেন, বখতেয়ার, অফিসের কাজ গুরুত্ব ও শ্রদ্ধা সহকারে করো, কখনো অসতর্কতাকে প্রশ্রয় দিয়ো না। পিয়ন গোলাম রসুল অফিসের সংবাদ তার কাছে পৌঁছায়। কিন্তু সে সব কথা পরিষ্কার বলতে পারে না অথবা বখতেয়ার নিজেই বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছে। তাদের দুজনকে একসঙ্গে নিকট অবস্থানে দেখে দমকা বাতাসের মতো তাদের কথার মাঝে বখতেয়ায়েরর স্ত্রী হাজির হয়। বখতেয়ার কানা আর গোলাম রসুল কালা মেনে নিতে পারে না সে।
একশ আশি দিন পর বখতেয়ার প্রথম অফিসে আসলো হেড কেরানির সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর অফিসে এলেও বখতেয়ারকে কেউ স্বাগত জানায় না, যেন অফিসে একটা লোকও তার পরিচিত ছিলো না। আজও নেই। তার জন্য, এতো বড় একটা দুর্ঘটনার পর, কারো মনে ব্যাকুলতা জাগলো না। সে অবাক হচ্ছে, অফিস তো ঠিকই আছে, এটা তো তারই অফিস। একটানা পঁচিশ বছর সে এখানে চাকরি করেছে। ইতোমধ্যে হেড কেরানির সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্তটা তার দুর্বল হয়ে গেছে। দরজায় একই পর্দা ঝুললে কী হবে, ভেতরের মানুষটা হয়তো বদলে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে সে তার চশমাটা পরে নেয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে তার মনে হচ্ছে, সবটা মুখ তার সবুজে ঢাকা পড়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে, এটা একটা ষড়যন্ত্র, সব কেরানিরা মিলে তার বিরুদ্ধে লেগেছে। আজ বোধহয় কেউ আর তাকে চিনবে না। অথবা হয়তো সে নিজেই চিনবে না কাউকে। সে সিঁড়ির দুধাপ নিচে নেমে এসে চশমাটা আড়াআড়িভাবে ধরে অফিসের সাইনবোর্ডটা পড়তে চেষ্টা করলো, হ্যাঁ নাম তো ঠিকই আছে।
বখতেয়ার সারাদিন তার সেই আগের চেয়ারটাতে বসে থাকলো। কিন্তু কেউ তাকে একটা ফাইল দিলো না কিংবা কিছু জিজ্ঞেস করলোনি। সে দেখলো, অফিসের কাজ তাকে ছাড়াই যথারীতি চলছে। কোথাও তার কোনো প্রয়োজন নেই। তার উপস্থিতি-অনুপস্থিতিতে কোনো পার্থক্য নেই। একসময় ব্যাপারটা তার কাছে অসহ্য মনে হলো। সে উঠে হেড কেরানির কক্ষে গেলো। জানতে চাইলো, হেড ক্লার্ক সাহেব আমার কাজ কী?
হেড কেরানি কিছুটা সময় নিয়ে তার সামনের খোলা ফাইলটা বেঁধে এক পাশে রাখলো। এরপর চশমাটা সামান্য নিচে নামিয়ে আড় করে ধরে বখতেয়ারের দিকে তাকালো। চিনতে পারার ভান করে বললো, ও তুমি। এবার অন্য একটি ফাইলে হাতে চালাতে চালাতে বললো, গোলাম রসুল, তোমার ব্যাপারটা আমি ঠিক জানি না। সেকশন অফিসার ভাকিল সাহেব তোমার সম্পর্কে কী জানি ইন্টারেস্টিং একটা গল্প বলেছিলেন। আচ্ছা, তোমাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, ব্যাপার কি বলো তো? বখতেয়ার হঠা যেনো অনেক ওপর থেকে নিচে পড়ে গেলো। এবং সে তেমনি আহতের মতো কাঁদতে শুরু করলো। কেরানি সাহেব আমি গোলাম রসুল নই; বিল ক্লার্ক বখতেয়ার।
ঠিক আছে তুমি বখতেয়ার। কিন্তু কাগজ-পত্র তো বলছে তুমি গোলাম রসুল।
এটা কী করে সম্ভব?
কাগজপত্রে আপনারা যাই লিখুন আমি আসলে বখতেয়ার।
শোন, গোলাম রসুল অথবা বখতেয়ার আইনের চোখে এ দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমি মানলাম, তুমি বখতেয়ার, কিন্তু বাস্তবতা তো তোমাকে অনুধাবন করতে হবে। মনে রেখো, এটা একটা অফিস, এর নিজস্ব কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে। আর সে সব নিয়ম-কানুনের আওতাধীন তুমিও বখতেয়ার। কিন্তু যখন কেইসটা শুরু হবে এবং এ সংক্রান্ত ফাইলগুলো নড়তে থাকবে, ভেবে দেখো, তখন বখতেয়ার আর অফিস শব্দটা গড় হাজির থাকবে না।
আপনার কথানুযায়ী তাহলে আমি বিল-ক্লার্ক বখতেয়ার নই?
তুমি যেমন বখতেয়ার কিংবা-বখতেয়ার নও, ঠিক তেমনি এটা অফিস কিংবা অফিস নয়। এর অর্থ তুমি যতোই দৌড়াও অফিস তোমার পেছনে দৌড়াবে না। কারণ, তুমি আর এখন এখানে নেই। তোমার না থাকাটা থাকার মতোই গুরুত্বপূর্ণ কিংবা গুরুত্বহীন। এটাতো সত্য, অফিসের অস্তিত্ব না থাকলেও তুমি থাকবে, আবার একইভাবে, তুমি আছো কি নেই এর ওপর নির্ভর করে না অফিসের বর্তমান অস্তিত্ব। এটাই সন্দেহজনক যে অফিসই যদি না থাকে তুমি কিভাবে বখতেয়ার হও?
বখতেয়ারের মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। হেড কেরানি এরপরও বলে যাচ্ছে, গোলাম রসুল তুমি অবশ্যই অফিসে উপস্থিত থাকবে। তোমার প্রতি আমার একটা কর্তব্য আছে না, আফটারঅল তুমি আমার নিজের মানুষ। আল্লাহ সাক্ষী, আমার ছেলেমেয়েরা সব সময় তোমার কথা বলে। তারা বলে, বখতেয়ার বা গোলাম রসুল আঙ্কেল কী যে চমকার গল্প বলেন। একদিন তাদের আম্মাও বলেছিলো, বখতেয়ারের স্ত্রীকেতো মাঝে-মধ্যে তুমি লিফট দিতে পারো? আহা বেচারি...!
হতভাগা বখতেয়ার, জীবনের এতোগুলো বছর পার করে এসে আজ তুমি নিজেই তোমার পরিচয় হারিয়ে ফেলেছো। তুমি গোলাম রসুল না বখতেয়ার একথা এখন তোমাকে কে বলে দেবে? সে বললো, আপনি সব জানেন স্যার। তাছাড়া আপনি বড় দয়ালু।
হেড কেরানি এবার সিরিয়াস হলেন। গোলাম রসুল আমি আর দয়া দেখাতে পারলাম কোথায়? যদিও দয়ারই অন্তর আমার। তবু আমি এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারবো না। কেইসটা তোমার জটিল। বিনা শাস্তিতে রেহাই পাবে না তুমি। তোমার জন্য আমার সহানুভূতি রয়েছে, কিন্তু তা তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। তোমার দরকার নিজের প্রতি দয়ালু হওয়া। আমার তো মনে হয় তুমি নিজেই তোমার বিরোধিতা করছো। তুমি মনে করছো তুমি বখতেয়ার, আমিও তাই মনে করি। কিন্তু তোমার আমার চিন্তা বা মনে করার বাইরেও একটা জগ আছে। তাছাড়া, আমরা আইনের লোক, কেইসটা ডিলও আমরাই করছি। আমরা তো আর আইন ভাঙতে পারি না।
কেইসটার কতোটুকু অগ্রগতি হয়েছে স্যার? বখতেয়ার হতাশ কণ্ঠে জানতে চাইলো।
কেইস! কিসের কেইস? হেড কেরানি যেনো আকাশ থেকে পড়লো।
কেইস স্যার একটু আগে আপনি যেটার কথা বললেন।
ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেইস। তোমার কেইস। আচ্ছা বলো তো কেইসটা না কী সম্পর্কীত? এরকম একটা কেইসের নথি আমার কাছে এসেছে, উল্টে দেখিনি। সত্য বলতে কী সময় পাইনি। বড্ড ব্যস্ততার মধ্যে আছি। আমার ধারণা এ সম্পর্কে বিস্তারিত কেউ-ই কিছু জানে না। কেউ যদি কিছু জানেনই তিনি সেকশন অফিসার ভাকিল সাহেব কিংবা মিস ব্যানার্জী। আর সবচেয়ে বেশি হয়তো জানেন বড় সাহেব। গোলাম রসুল, বখতেয়ার বা আর যেনো তুমি হও, তোমার কেইসটা বড় জটিল। এটাকে সহজ করার কোনো শক্তি তো আমাদের কারো নেই। আবার তুমি আমার সঙ্গে জড়িয়ে আছো, আমি জড়িয়ে আছি অন্যদের সঙ্গে। ব্যাপারটা আরও তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এরচেয়ে তুমি বরং সেকশন অফিসার জি.কে ভাকিল সাহেবের সঙ্গে দেখা করো। অফিসের নিয়মানুযায়ী তার সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ আমি তোমাকে দিতে পারি না, বড় মানুষ নানান কাজে ব্যস্ত থাকেন। কেউ না কেউ পাশে থাকেই। তার কাছে পৌঁছা একটু কঠিন-ই বটে। হেড কেরানি বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন। বখতেয়ারের কানে তার শেষের দিকের কথাগুলে আর ঢুকলো না। তার মাথায় এখন একটাই নাম সেকশন অফিসার বাকিল সাহেব। বখতেয়ার বাকিল সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলো। এখন নিজেকে তার কিছুটা সুখী, সফল ও হাল্কা লাগছে। আগেই সে শুনেছিলো, তাদের ব্যাপারে সবাই কমবেশি উদ্যোগি হয়েছে। জেনেছিলো; ভালো কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এতোকিছু সত্ত্বেও সে দুর্বল, তার শ্বাস-প্রশ্বাস গোনা যাচ্ছিলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা তার ঘুরতে থাকে। তার মনে হচ্ছে, তার দুর্বলতা নিশ্চয়ই কারো নজরে পড়বে, আর তাতেই তার ভাগ্য সুসম্পন্ন হবে। আবার অনুশোচনা হচ্ছে এই ভেবে যে প্রথমেই কেনো বাকিল সাহেবের সঙ্গে দেখা করিনি? একমাত্র বাকিল সাহেব সচেষ্ট হলেই তার সমস্যা দূর হয়ে যায়। কেইসটার ব্যাপারে আগেই হয়তো সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। বাকিল সাহেব ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কাঠখোট্টা আচরণ করলেও লোকটার অন্তর কোমল। কথায় কথায় বকাঝকা দিলেও কারো ক্ষতি করেন না। তার কথায় কারো মনে আঘাত লাগলেও কলম কারো বেতন কাটে না। অল্প সময়েই অনেক উন্নতি করেছেন, ভাগ্যদেবী তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। যদিও অনেক বড় একটি পরিবার তিনি সামলান তবু খরচ-পাতির ব্যাপারে দরাজদিল। দান-খয়রাতও করেন প্রচুর, যেন হাতেম-তাঈ। অবশ্য এও ঠিক যে, যারা আল্লাহর বান্দাদের দেন, আল্লাহ তাদের দেন। কিন্তু আমার সব সময় অভাব। নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। আয় যে একেবারে করতাম না তাতো নয়, কিন্তু পরিধান করার মতো একটা ভালো কোটও আমার নেই। সেই যে কবে বাংলাদেশি একটা কালো কোট কিনেছিলাম। মনেই নেই। আমি আমার শক্তি ও উদ্যমকে যথার্থ উপাদনশীল কাজে লাগাতে পারিনি। এটাই আমার ব্যর্থতা। বরাবরই ভেবেছি, প্রমোশন হবে, গ্রেডেশন লিস্টে নাম যাবে। তখন নিশ্চয়ই দুরাবস্থা থাকবে না। কিন্তু সব চিন্তা বরাবরই ছিলো ভুল। প্রমোশন হয়নি। আয় বাড়েনি, শুধু বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। কতোই না বোকা আমি! সবসময় ভাবতাম, বড় সাহেব আমার দেয়া নোটগুলো পড়েন, তিনি নিশ্চয়ই আমার কাজে সন্তুষ্ট। না হলে ভুল ড্রাফটের জন্য ডেকে পাঠাতেন। অথচ প্রকৃত ঘটনা ভিন্নরকম। হেড ক্লার্ক সাহেবের দস্তখতের পরে তিনি শুধু কাউন্টার দস্তখত করেন। নোট কে দিলো কী দিলো কদাচ দেখেন। এভাবেই বড় সাহেব আর আমার মাঝে উঁচু একটা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হেডক্লার্ক সাহেব। কাজেই আমি কোনোদিন বড় সাহেবের চোখেই পড়িনি। আমি তো বড় সাহেবকে দেখিই। তার কাছেই পড়ে আছে আমার রিজিকের ফয়সালা। কতো নির্বুদ্ধিতার পরিচয় আমি দিয়েছি-গত পঁচিশ বছর তার সঙ্গে দেখা করার কোনো চেষ্টাই না করে। এমন অবস্থারও সৃষ্টি হয়নি যে তার মুখোমুখি হয়ে দুদণ্ড কথা বলেছি। আজ আর এসব কথা ভেবে কী লাভ? সচেতনভাবে কখনো কোনো অপরাধ করিনি এটাই বড় সান্ত্বনা। হেড ক্লার্ক আর বাকিল সাহেব তারা দুজনেই যতো কামড়াকামড়ি করেন। যদি কোনোদিন সুযোগ পাই এদের আমি মরণ কামড় দিয়ে ছাড়বো। আমার বাহুতে এখনো এদের দমন করার মতো শক্তি রয়েছে। সমস্যা একটাই, শেষ পর্যন্ত একটা খুনের মামলা হবে, আর খুনের মামলাটা বর্তমানের মামলার চেয়েও শ্বাসরুদ্ধকর হবে। হয়তো শাস্তিও হয়ে যাবে দ্রুত। অবশ্য প্রকৃত সত্যটা যাদের জানা থাকবে তারা কেউই আমাকে ঘৃণা করবে না।
এসব চিন্তার মাঝেই সে অনেক জনপদ পার হয়ে এসেছে, অতিক্রম করেছে সহস্রেরও বেশি মাইল পথ। এবার তার মনে হচ্ছে, যে এলাকাটায় এখন সে এসে পড়েছে, এটার ভূমিরূপ ভিন্নধরনের। ফসলের মাঠ, ঘরবাড়ি, নদী, নারী রাজপথ সব ভিন্ন। পরিষ্কার প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধ দোকানপাট। কাপড়, জুতো, ইলেক্ট্রনিকস দ্রব্য দেদারসে বিক্রি হচ্ছে, প্রতিটি দোকানে উপচে পড়া ভিড়। প্রতিটি রাস্তার প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিদ্যালয়গুলো ঘোষণা করছে শিক্ষা, মৈত্রী ও সাম্যের বার্তা। কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের উল্লাসে ভরা কোলাহল শুনে বখতেয়ার সুন্দর আগামীর কথা ভাবছে। হলুদ ও শাদা বর্ণের পাঁচতলা বাড়ি। কতোকগুলো বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে পাহারাদার বিড়ি টানছে, দৃষ্টিতে তাদের রাজ্যের উদাসীনতা। রাস্তার ডান পাশের পথে বেঞ্চের ওপর বসে শ্রমক্লান্ত লোকেরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে। যুবতী মেয়েরা তাদের কুকুরের রশি ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বখতেয়ার খুব অবাক হচ্ছে, এ যেনো রূপকথার দেশ। যার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তার মনে হচ্ছে, একটি নতুন শহরের দিকে সে যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে একটি প্রাসাদ সমান ভবনের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে-যার সবকিছুই সুন্দর। প্রতিটি জানালায় অ্যালুমিনিয়ামের গ্রিলে রঙিন কাঁচ লাগানো। কাঁচের ওপর আবার পর্দা টানানো-যে পর্দা ভেদ করে বাইরের শব্দ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। বখতেয়ার এমন শব্দ পছন্দ করে। গেট দিয়ে সে ভেতরে প্রবেশ করলো। সামনের করিডোরের সিঁড়ি দিয়ে সে কয়েক ধাপ ওপরে উঠে গেলো। কিন্তু তার দুর্বলতার কারণে পা দুটো তার উপরে উঠছেনা। তাই ওপরে উঠতে গিয়ে মনটা তার হঠা খারাপ হয়ে গেলো। মনে হয়, কী হবে বাকিল সাহেবের সঙ্গে দেখা করে? তারচেয়ে বরং ফিরে যাই। এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেও সে ওপরে ওঠা বন্ধ করে না। বাকিল সাহেবের রুমটা কোন পাশে এতোদিনে সে ভুলে গেছে। অথবা হয়তো বাকিল সাহেব নিজেই রুমটা বদলে ফেলেছেন। এ সময়ই কালো চশমা পরা একটা লোক তার সামনে পড়ে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই সে জানতে চাইলো, বাকিল সাহেব কোন রুমে বসেন?
লোকটা তার মুখের কোণ দিয়ে কায়দা করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো। এরপর মৃদু হেসে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার বদলে পাল্টা প্রশ্ন করলো। কোন বাকিল সাহেব?
মি. বাকিল মানে সেকশন অফিসার জি. কে বাকিল সাহেব। বখতেয়ার দ্রুত উত্তর দেয়। লোকটা তাকে চোখের ইশারায় ওপরের তলা দেখিয়ে নিজেও ওপরে উঠে যেতে থাকে।
বখতেয়ার ভয়ে ভয়ে লোকটাকে অনুসরণ করে। লোকটাকে ছোটখাটো একটা সন্ত্রাসী মনে হচ্ছে। সে দ্রুত বারান্দা পেরিয়ে কোনো একটা রুমে ঢুকে যায়। বখতেয়ার দাঁড়িয়ে থাকে আর কারও দেখা পাওয়ার আশায়। কারণ, ওপরের তলার সবগুলো রুমেই কেমন ভীতিকর অন্ধকার। কারও সাহায্য না পেয়ে সে বারান্দার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যায়। প্রতিটি রুম যথাসম্ভব তন্ন তন্ন করে খুঁজে, কী বাকিল সাহেব কিংবা কালো চশমাওয়ালা, কাউকেই সে দেখতে পেলো না। মৃত্যুপুরীর নির্জনতা চারপাশে। ক্রমশই অন্ধকার বাড়ছে। বখতেয়ার নেমে যেতে থাকে পূর্বের সিঁড়ি দিয়েই। সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলে সে পিছলে যাওয়ার ভয়ে। আর তখনই একসারি ঝকঝকে শাদা দাঁত তার সামনে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। অর্থাৎ সেই কালো চশমাওয়ালা লোকটা। বখতেয়ার সহজেই চিনে ফেলে তাকে। এবার লোকটাই তাকে জিজ্ঞেস করে, প্রিয়তম, তুমি কাকে খুঁজছিলে?
বাকিল সাহেব।
বাকিল সাহেব? নামটা যেনো জীবনে এই প্রথম শুনেছে অমনভাবেই প্রশ্নটা সে করলো।
হ্যাঁ বাকিল সাহেব। আপনি বলেছিলেন, তিনি ওপরের তলায় বসেন। মনে পড়ছে? কোথাও তাকে পাইনি-সবটা ফ্লোর, প্রতিটি রুম খুঁজেছি। তিনি সম্ভবত এখানে বসেন না।
কালো চশমাওয়ালা লোকটা এবার ঘুরে দাঁড়ায় এবং বখতেয়ারকে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে। কিন্তু রুমের ভেতরে কিছুই দেখা যায় না। তবে বোঝা যায় রুমটা খালি, গুমোটবাধা ভ্যাপসা গরমের সঙ্গে বিষাক্ত একটা ধোঁয়া রুমটাতে রাজত্ব করছে। অনেকদিন এ রুমের চুন-কাম করা হয়নি। কালি-ঝুলি ঝুলে আছে, প্লাস্টার খসে গেছে। লোকটা বখতেয়ারকে খালি একটা চেয়ার দেখিয়ে দেয়। এবং নিজে নোংরা একটা পর্দা টেনে দিয়ে বেরিয়ে যায়। বখতেয়ার আবার রুমটার প্রতি মনোযোগ দেয়, রুমটার একপাশে একটা খাট, ছেঁড়া নোংরা একটা চাদর ওতে বিছানো এবং চাদরের ওপর তেল চিটচিটে একটা বালিশ। অন্য পাশে আধভাঙ্গা একটা টেবিল। টেবিলের ওপর একটা রেডিও সেট। ওয়ালে টানানো নায়ক নায়িকাদের ঢাউস আকৃতির ছবি; পাশেই দেব-দেবীদের উপস্থিতি। সবকিছু মিলিয়ে এক দারুণ অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। বখতেয়ার ভাবছে, কোন ভাগ্য দেবতা আমাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। এ সময়ই লোকটা ব্যস্তপায়ে ফিরে আসে। বখতেয়ারও উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, নমস্কার বাকিল সাহেব। আশ্চর্য এই বাড়ির সবগুলো রুমে আমি আপনাকে খুঁজেছি।
প্রিয় সুহৃ! কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন কাজ। আসলে হতাশায় ভেঙে পড়লে এমন হয়। হাতের কাছের জিনিসও খুঁজে পাওয়া যায় না। আগে তুমি আমাকে চিনতে পারোনি। ওটা কোনো ব্যাপার নয়, কদিনই বা আর আমাদের মুখোমুখি দেখা হয়েছিলো? অবশ্য কোনো কিছু চিনে নেয়ার জন্য অন্ধকার একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। চারদিকে তাকাও, দেখো, কী ভয়ানক ধোঁয়াটে অন্ধকার। তবে একটা কথা, নিজেকে চেনাই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি কঠিন কাজ। যদি আমরা পারতাম তাহলে আমাদের জীবন অন্যরকম হতো। কি বলো হতো না? জানি, তুমি খুব বুদ্ধিমান, ঠিক কি না প্রিয়তম?
নিঃসন্দেহে। বখতেয়ার ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে। তাইতো আজ আমি আপনার কাছে এসেছি। আপনি আমার ব্যাপারে কী চিন্তা করেছেন? বিপদে পড়লে বিচারবুদ্ধি লোপ পায়। না হলে দীর্ঘ সময় একই সঙ্গে একই জায়গায় চাকরি করেও আপনাকে চিনতে পারিনি। আসলে ব্যাপারটা ছিলো ধোঁয়াচ্ছন্ন। স্বাস্থ্যটা খারাপ, এক ধরনের দুর্বলতা ভেতরে বাসা বেঁধেছে। আগে শুধু এইটুকুই জানতাম, এখন জেনেছি, চোখেও আমি ভালো দেখতে পাই না। মানুষ চিনতে ভুল করি।

বখতেয়ার পুনরায় চেয়ারটায় বসতে বসতে বলে, আপনি গোপীকৃষ্ণ বাকিল, অর্থা সেকশন অফিসার বাকিল সাহেব। বয়োজ্যেষ্ঠ উচ্চপদস্থ অফিসার। স্যার আমি আপনাকে ঈশ্বরের চেয়েও বেশি ভালোবাসি স্যার। এ কথা দ্বারা ঈশ্বরকে ইনসাল্ট করছি না, শুধু আপনার প্রতি আমার অন্তরের টান কতোটুকু তাই তুলে ধরছি। কালো চশমাওয়ালা লোকটা এতোক্ষণই একটা ভাব ধরে বসেছিলো। এখন সে সিরিয়াস হলো। জিজ্ঞেস করে, অতোকথা বলার পেছনে তোমার উদ্দেশ্যটা কী বলো তো।
আপনি তো সবই জানেন স্যার। পঁচিশ বছর আমি কাজ করেছি। আমার কাগজপত্র পরিষ্কার। আমার এ.সি.আর ভালো। নিয়মানুবর্তী, কাজ-পাগল, অমায়িক ব্যবহার, নৈপুণ্যতা এসব ব্যপারে অফিসে আমার সুনাম ছিলো। আমি আমার দক্ষতার সীমাও অতিক্রম করেছি। কিন্তু এখন স্যার...।
এখন কী বলো...।
এখন একটা কেইস...?
কেইস? কালো চশমাওয়ালা লোকটা হঠা যেনো লাফিয়ে ওঠে। আরে ভাই, কেইসের মধ্যে কে নেই? আজ তুমি, কাল আমি, পরশু অন্যজন। সমস্যা হলো, কিছু কিছু কেইস বড় জটিল, এটা তুমিও জানো আশা করি। আমাদের অফিসের অনেকের কেইসের কথা জানি। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম পর্যন্ত চলছে। এটা কেইসের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে। তোমার কেইসটা তো সবে হামাগুড়ি দিচ্ছে। উদ্বিগ্ন হচ্ছো কেনো?
উদ্বিগ্ন শব্দটা শুনে বখতেয়ার এবার সত্যি সত্যি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। সে শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে ঘামতে শুরু করে।
বখতেয়ার তোমার কেইসটা তুলনামূলকভাবে কম জটিল। বেশিদিন হয়ওনি। তোমার জীবদ্দশাতেই শেষ হতে পারে। কল্পনা করো, আল্লাহ না করুন তুমি মরে গেছো, অথবা আমারই কিছু একটা হয়ে গেছে অথবা বড় সাহেব অন্যত্র চলে গেছেন-তখন তোমার কেইসের কী হবে? পরিবার ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
বখতেয়ারের স্ট্রোক হওয়ার উপক্রম হলো। সে দুর্ঘটনার প্রথম দিনটির কথা মনে করলো। আলমারিটা কাঁপছিলো, হঠা যেনো একটা কামান গর্জে উঠলো। তখনই কিছু ভারি বস্তু বখতেয়ারকে আঘাত করলো। এরপর সবকিছু অন্ধকার, গত ছমাস ধরে অন্ধকার। অসুস্থতা, দারিদ্র্য, উলঙ্গ ছেলেমেয়ে, হতাশাগ্রস্ত স্ত্রী, শূন্য ঘর, ডাক্তার, ওষুধ, বন্ধু ও আত্মীয়দের পরামর্শ, অফিসের চিঠি এবং পিতার সন্দেহমূলক করুণার্দ্র চাহনি, এই সবই তাকে সহ্য করতে হচ্ছে।
বখতেয়ার চিৎকার করে ওঠে। বাকিল সাহেব আমাকে বাঁচান, আপনিই কেবল জগতের সকল গোপন বিষয়াদির জ্ঞাতা, ঈশ্বরই আপনাকে নিজের স্থানে স্থলাভিষিক্ত করেছেন তাঁর কর্ম সম্পাদন করার জন্য। আপনি যিশুর প্রেমিক, আপনি মোশিয়া এবং বৌদ্ধ। আপনি সকল পাপীর ত্রাতা। আমাকে আপনার পায়ের নিচে স্থান দিন। সে যখন চোখ বন্ধ করলো দুগালের ওপর দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
কালো চশমাওয়ালা লোকটা এবার নড়েচড়ে বসে মুখভর্তি সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, বখতেয়ার তুমি খুব দুর্বল, মৃতপ্রায় মানুষ। গীতার সেই কথাটি তুমি বোধহয় ভুলে গেছো, কাজের জন্য কাজ করো, প্রাপ্তির আশায় নয়। নামাজ এবং প্রফুল্লতাও খুব জরুরি। প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে আসে তার চারপাশের বৃত্ত ভেঙে আত্মার যথার্থ মুক্তির পথ অনুসন্ধান করতে। কিন্তু তুমি বখতেয়ার তা করছো না। কতোই না অজ্ঞ তুমি, শিশুসুলভ আচরণ করছো। এখন অবশ্য নিজেকে আমার তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দিয়েছো। আর আমিও তোমাকে জানি। শোনো, তুমি ভয় পাচ্ছো, এবং যারা তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে তারা সবাই আমার নখদর্পণে। এখন দেখো, তোমার জন্য কী অপেক্ষা করছে।
বখতেয়ার রুমালে চোখের পানি মুছে অন্ধকার রুমের দিকে বোকার মতো তাকাচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে, কালো লোকটা ক্রমশ একটা ঘোড়ার রূপ নিচ্ছে। আর তার মুখটা বিশাল হয়ে যাচ্ছে। চোয়ালের দুসারি দাঁত ছাড়া তার আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভয়ার্ত বখতেয়ার লোকটার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। এ সময় সে ঘরের অন্ধকার কোণে মেয়ে মানুষের মোলায়েম কণ্ঠের মিষ্টি হাসি শুনতে পেলো। সে আরও মনোযোগ দিয়ে তাকায়। ওখানে একটি আরাম কেদারা দুলছে, একটি মনুষ্য ছায়া কেদারার ওপর বসে ব্যস্তভাবে কি যেনো করছে। আরও সতর্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে ধরে সে। একটি সুন্দরী যুবতী দৃশ্যমান হলো। যুবতীটি আর কেউ না, মিস রীণা। বখতেয়ার বিস্মিত। এই ভয়ানক লোকটার সঙ্গে মেয়েটা করে কী? বখতেয়ার বুঝতে পারে, তার বিস্ময়ে কারও কিছু এসে যায় না। মিস রীণা আপন মনে সুয়েটার বুনে যাচ্ছে। এবং তাদের সব কথা শুনছে। বখতেয়ার এ সম্পর্কে আগে কিছুই জানতো না। সে যেনো একটা ঘোরের মধ্যে পড়েছে। কিছুক্ষণ এভাবেই কাটে তার। এবার বখতেয়ারের মনে হয়, সে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সত্যি ওটা মিস রীণা, সুয়েটার বোনার সুঁইগুলো এক পাশে রেখে বখতেয়ারের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে তার কাঁধে হাত রাখে। বখতেয়ার কালো লোকটার কথা ভুলে গেছে। মিস রীণা আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তার। রীণার ঠোঁট দুটো হাসছে, চোখ দুটো নাচছে। এবং সে উবু হয়ে বখতেয়ারের ঠোঁটে চুমু দিচ্ছে। একবার, দুবার, তিনবার এভাবে বারবার। বখতেয়ার সেই আপেল রাঙা গাল দুটোর ছোঁয়া পাচ্ছে, গত পঁচিশ বছর অফিস শেষে বাড়ি ফেরার সময় জানালার ছিদ্র দিয়ে তাকিয়ে সে যাদের দেখে এসেছে। তার চোখ দুটো এতোদিন শুধু বড় সাহেবের টেবিলের পাশেই ডানা ঝাঁপটে মরতো, নিঃশ্বাসের শব্দে শুধু বড় সাহেবের কানের লতি লাল হতো। আজ এসবই বখতেয়ারের। সে মিস রীণার কবোঞ্চ শরীর জড়িয়ে ধরে নরম স্তন দুটোতে চাপ দিচ্ছে। সারা দুনিয়া এমন কি নিজেকেও সে ভুলে গেছে। মুর্ছা যাওয়া অবস্থা তার। যখন সে প্রকৃতিস্থ হলো, তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কেনো এমন হলো সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, তবে ধরে নিয়েছে যে, এটাই তার জীবনের সর্বশেষ দুর্ঘটনা। কালো লোকটা পুঞ্জিভূত বাজির টাকা বিজয়ির মতো হাসছে আর মিস রীণা চা খাচ্ছে। তার ঠোঁটেও মৃদু হাসি। ভয়ানক লোকটা এবার দাঁড়িয়ে জননেতাদের মতো হাত ওপরে উঠিয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করলো।
বখতেয়ার, এটা অত্যন্ত তাপর্যপূর্ণ ও আনন্দের ব্যাপার যে, তুমি কাউকে অন্তত চিনতে পেরেছো। আজ তুমি তোমার পথের অনেক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এসেছো। যতো তাড়াতড়ি তুমি তোমার চারপাশ চিনতে পারবে ততো দ্রুত তোমার কেইসটা নিষ্পত্তি হবে। আমি সে রহস্যই আজ প্রকাশ করছি। এই যে মিস রীণা, বড় সাহেব, এমন কি আমার কন্যা এরা সবাই চালাক। এবং সতর্ক।
তিনি (মিস রীণা) হাজার বছর ধরে অফিসে চাকরি করছেন। মন্দের ভালো যে তুমি আজ তাকে চিনতে পেরেছো। এটা তোমার মধ্যে বিশ্বাসের জন্ম দেবে। হঠা বখতেয়ারের মনে হচ্ছে, একসঙ্গে অনেক লোকের কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে, যেন তাকে শূলে চড়ানোর আয়োজন চলছে। লোকেরা এসেছে একটা মানুষকে শূলে চড়ানোর দৃশ্য দেখতে। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য ঝুলন্ত অবস্থায় লোকটা যে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাবে তাই তাদের অনাবিল আনন্দ দান করবে। মানুষকে গলা টিপে হত্যা করার আনন্দের নাকি তুলনা হয় না। বখতেয়ারের গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। মিস রীণা ও কালো চশমাওয়ালা লোকটাও নিরব। অদ্ভুত এই নিরবতায় রুমের তিনজন মানুষ যেনো একটি অঙ্কিত দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
এবং এরপর ছায়া দুটিতে জীবন ফিরে আসে। তারা বখতেয়ারের কাছাকাছি হয় এবং একজন তার বামে একজন ডানে বসে। তারা বললো, শোনো বখতেয়ার। বখতেয়ার শুনতে লাগলো। কিন্তু কী শুনছে কিছুই মনে করতে পারছে না। তার শুধু মনে হচ্ছে, অনেক সময়, বছর-যুগ-শতাব্দি ধরে সে চলছে। অনেক দৃশ্য পথ-প্রান্তর পার হয়ে যাচ্ছে। এখন সে দুর্বল আর বৃদ্ধ হয়ে সরে যাচ্ছে তার সন্তান আর পরিবার থেকে। সে নিজেকে অন্ধকারেরই একটা অংশ মনে করছে। অথবা মনে করছে, পড়ন্ত জলস্রোত অর্থহীন কিন্তু চিরন্তন একটি সুরের সৃষ্টি করে আছড়ে পড়ছে বিশাল শিলা খণ্ডে। এ যেনো হিন্দি, আরবি, ফার্সি ইত্যাদি অসংখ্য ভাষার সম্মিলিত সুরধ্বনি। সে দুহাতে চোখ মুছে গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস টানে। এবং সিদ্ধান্ত নেয়, একটা কিছু করবে বলে। এবং সঙ্গে সঙ্গে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এরপর সে উন্মুক্ত রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে রঙিন পৃথিবীটার দিকে তাকালো। খেলায় মেতে ওঠা প্রাণোচ্ছল শিশু, অভিজাত ঘরবাড়ি, রঙিন কাঁচের দরজা-জানালা, আলোক ছড়ানো বৈদ্যুতিক বাতি, গাড়ির বহর, দোকানগুলোয় উপচে পড়া ভিড়, সর্বত্র কর্মতৎপরতায় ব্যস্ত লোকজন তার চোখে পড়লো। অমন চমকার পরিবেশে নিজেকে বড় বেমানান মনে হচ্ছে। এসময়ই রাস্তার ওপাশে মিস রীণাকে দেখতে পেলো সে। মিস রীণা, হালকা পাতলা গড়নের মেয়ে, শাদা মুখমণ্ডল, বাদামি চুল, ধারালো চিবুক, লাফানো স্তন..। নিজেকে বখতেয়ারের বড় বিধ্বস্ত, নিঃশেষিত ও পরাজিত লাগছে। অসময়ে হলেও মিস রীণাকে পেয়ে কিছু বলতে এগিয়ে যায় সে। কারণ দীর্ঘদিন একসঙ্গে চাকরি করেছে, রীণাকে সে কখনো দূরের মানুষ মনে করেনি। কিন্তু রীণা দাঁড়ায় না, ব্যস্ত হাত ওপরে উঠিয়ে বলে, যা বলার আগামীকাল বলো।
মিস রীণার আগামীকাল অর্থা পরদিন অফিসে গেলো বখতেয়ার। একই বিল্ডিং, দরজা-জানালা-পর্দা, একই টেবিল-চেয়ার, আলমারি, অফিস কক্ষ, কিছুই বদল হয়নি। শুধু পিয়ন গোলাম রসুল নেই, এইটুকুই শূন্যতা, সে রিটায়ারমেন্টে চলে গেছে। নতুন পিয়নটাকে বখতেয়ার চেনে না। আগের সেকশন অফিসার অর্থাৎ বাকিল সাহেব হরিদুয়ারে চলে গেছেন। এখন মিস রীণাই সেকশন অফিসার। অন্য আরেকজন কেরানিও যোগদান করেছে। বখতেয়ারের তবু খারাপ লাগেনি। সে মিস রীণার কাছে গিয়ে বসে। কিন্তু রীণা তার দিকে ফিরেও তাকালো না। নিচের দিকে তাকিয়ে থেকেই তার নাম, পিতৃপরিচয় জিজ্ঞেস করলো। জাতীয়তা ও স্থায়ী ঠিকানাসহ একটি দরখাস্ত দিতে বললো। বখতেয়ার এজন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। নিজেকে তার বড় অসহায় লাগছে, সে তার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারছে না। তার শুকিয়ে যাওয়া গলা দিয়ে কোনো শব্দই বেরোলো না। হঠা দেখলে মনে হবে সে কিছুই শুনতে পায়নি। কলের পুতুলের মতো পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে সে মিস রীণার হাতে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু দেবার সময় টুকরোটা হাত ফসকে পড়ে যায়। বখতেয়ার মরিয়া হয়ে সেদিনের সেই অন্ধকার রুমের কথা, কালো লোকটার কথা, তার উষ্ণ যৌবন, চুমু, আলিঙ্গন, তার ঠাণ্ডা ঝুলে পড়া স্তন এবং সবশেষে তার বলা আগামীকাল কথাটি মনে করাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সকল চেষ্টাই তার বৃথা যায়। মিস রীণার এহেন আচরণে সে খুব হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। তার হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে চেয়ার ছেড়ে রীণা আলমারির কাছে যায় এবং টেনে ভারি একটা ফাইল বের করে। ফাইলের ফিতা খুলে অনেকগুলো নথিপত্র টেবিলে স্তূপিকৃত করে। কিছু কাগজ ছুঁড়ে মারে ময়লার ঝুড়িতে। আবার নতুন কাগজ যুক্ত করে কতোকগুলোর ওপর কিছু লিখে এবং লেখা শেষ হলে ফাইল ফিতাবন্দী করে ছুঁড়ে দেয় বখতেয়ারের দিকে। বখতেয়ার ফাইলটি হাতে নেয়, ফাইল নয় যেনো ভয়ানক ভারি একটি বোঝা। সে ওটাকে কাঁধে উঠিয়ে অন্য একজন কেরানির কাছে ছুটলো নতুন নোট লেখাতে। এভাবে সে দ্বিতীয়, তৃতীয় কেরানির কাছে গেলো এবং সবার শেষে আবার রীণার সামনে হাজির হলো। মিস রীণা দারুণ সন্তুষ্ট, সে ভালোবাসাপূর্ণ চোখে বখতেয়ারের দিকে তাকালো। তার কাছ থেকে ফাইলটি নিয়ে বললো, তোমার কাজ শেষ। সকল সমস্যা দূর হয়ে গেছে। তুমি কতো ভাগ্যবান বখতেয়ার, তোমার কেইসটা এখন নিষ্পত্তি হওয়ার পথে। চলো, তোমাকে বড় সাহেবের রুমে দিয়ে আসি।
বখতেয়ারের নিষপ্রভ আশা এবার উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। মিস রীণার সামনে সে জোড়হাত হয়ে দাঁড়ায়। তার দুচোখে কৃতজ্ঞতার ছাপ। মিস রীণা তার হাত ধরে বললো, এসো। ভয়ে বখতেয়ারের দেহ কুঁজো হয়ে আসছে। মিস রীণাই বড় সাহেবের রুমের পর্দাটা সরিয়ে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে বখতেয়ারকে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। এবং পেছন থেকে নিজে সরে গেলে দরজা আপনাআপনিই বন্ধ হয় গেলো। কার্পেটে বখতেয়ারের পা দুটি বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছে। এবং তার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর আজই সে প্রথম বড় সাহেবের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। আগে শুধু পর্দার ফাঁক দিয়েই বড় সাহেবকে দেখেছে। দুর্ঘটনার পর বড় সাহেবের বাস্তব অবয়ব ভুলে সে কল্পনা করে নিয়েছে এমন এক বড় সাহেবের যার অনেকগুলো আকার। অনেকগুলো হাত-পা-মাথা-চোখ-মুখ। আজ বড় সাহেব তার সামনে, খুবই কাছে। কার্পেট মোড়ানো রুম, উঁচু গদির চেয়ার, পেছনে দামি ডেস্ক। তার মাথা আনত, পরিধানে দামি পোশাক, চোখে চশমা। দামি কলম দিয়ে লিখছেন ঝকঝকে শাদা কাগজে। অনেকক্ষণ পর সাহেব মাথা উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তুমি কে?
অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। সে টেবিলে ফাইলটা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আমি বখতেয়ার স্যার। এরপর সে সমগ্র ঘটনা এ টু জেড সবিস্তারে বর্ণনা করে। পাঁচ পাঁচটি বছর আগে দুর্ভাগ্য তার পিছু নিয়েছিলো। যখন আলমারিটা নড়তে শুরু করে...। বর্ণনা দিতে গিয়ে তার মুখে ফেনা উঠে যায়। পাতা উল্টাতে উল্টাতে বড় সাহেব শুনছেন। ফাইল পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে বখতেয়ারের মুখের দিকে চাইলেন। এসব কথা আমাকে বলে তুমি তোমার সময় নষ্ট করছো। আমি বড় সাহেব নই। আমি তার পি.এ মাত্র। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা কেবল বড় সাহেবেরই আছে। তিনি বসেন ভেতরের রুমে।
বখতেয়ার স্তব্ধ হয়ে গেলো তার সমস্ত উদ্যম বিফল হয়েছে দেখে। যা কিছু তার বড় সাহেবকে বলার ছিলো সবই তো সে বলে ফেলেছে। একই কথা সে আর কতোবার বলবে। সে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো।
দাঁড়াও বোকা বখতেয়ার। কে যেনো ডেকে বললো তাকে, সে স্পষ্ট শুনতে পেলো। অনেকগুলো স্তর, প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে তবেই তুমি বড় সাহেবের কাছাকাছি এসেছো। এখন ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। দোমনা করো না, শক্ত হও। বখতেয়ার শক্ত হয়। তাই তো এতো কাছে এসেও ফিরে যাবো কেনো? একবার দেখা করি, দেখি না আমার জন্য কি করেন তিনি। বিপর্যস্ত, হতোদ্যম বখতেয়ারকে সেক্রেটারি সাহেব নিজেই বড় সাহেবের রুমের দিকে এগিয়ে দিলেন। যদিও বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করার সব ইচ্ছে ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। কেইসটার সুরাহা হলো কী হলো না তার কাছে এটা এখন মূল্যহীন। তবু সে বড় সাহেবের সেক্রেটারিকে না বলতে পারলো না।
বখতেয়ার এখন বড় সাহেবের রুমে দাঁড়িয়ে আছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুখে কিছুই বলবে না। একটা কথাও না। এমন কি কোনো প্রকার দয়া ভিক্ষেও করবে না। সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলো একটুও কাঁদবে না, হাতজোড় করবে না, শুধু ফাইলটা সামনে রেখে অপেক্ষা করবে। সে একজন সকর্মচারি, নিজেকে আর কতো ছোট করবে?
বড় সাহেব গম্ভীর হয়ে কাগজে কীসব লিখছেন। টেবিলে ফাইল রাখার শব্দে মুখ তুলে চাইলেন তিনি। বখতেয়ার বড় সাহেবকে দেখলো, একটি মানবীয় অস্তিত্ব সম্পন্ন রক্ত মাংসের চেহারার একটি জীবন্ত মানুষ। যার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে, চোখের পাতা নড়ছে। চল্লিশ বা চল্লিশোর্ধ বয়স। বখতেয়ার বলতে চাচ্ছে ইতোপূর্বে সে তাকে কোথাও দেখেছে অথবা কোথাও তারা মিলিত হয়েছে। হঠাৎ তার মনে পড়লো, সে তাকে ঠিক চিনতে পেরেছে। সে কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে বললো, আদাব জনাব, আপনি কি ইসলামাবাদের আবদুল করিম নন?
বড় সাহেব ঠোঁট ভাঁজ করে একটু বাঁকা হাসি হাসলেন। বখতেয়ার বলতে থাকে, আপনি আবদুল করিম, হ্যাঁ-হ্যাঁ অবশ্যই ইসলামাবাদের আবদুল করিম ভাট। আপনি স্যার, নবছর প্রেসিডেন্ট ন্যাশনাল কনফারেন্সের হলকা ছিলেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত এই সময়টা সম্ভবত আপনি জেলে ছিলেন। এরপর আপনি কন্ট্রাক্টর হয়েছিলেন। আপনি কি সেই আবদুল করিম নন? আমার কথা কি ঠিক না স্যার?
বখতেয়ারের ওপর চোখ স্থির রেখে বড় সাহেব একটা পেন্সিল নিয়ে খেলা করছিলেন। তার এই নিরবতায় বখতেয়ারের মনে সন্দেহ হলো। সে কি আবার ভুল করছে? ভুল মানুষের কাছে তার মূল্যবান আবেগ ঝাড়ছে? ইনি হয়তো তিনি নন। কিন্তু সে নিশ্চিত এর আগে কোথাও তাদের দেখা হয়েছে। সে তার স্মৃতি সাঁতরে বেড়াচ্ছে। হঠা তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে চিকার করে বললো, আচ্ছালামু আলাইকুম পীর সাহেব। আপনি বাস্তবিকই একজন রসিক মানুষ। কী গম্ভীর হয়েই না বসে আছেন? চমৎকার নাটক বটে! মসজিদে কী পবিত্র নূরানী চেহারায় দেখি আর এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রূপ। খুবই দায়িত্ববান। ওখানে থাকেন খুব সাদাসিদে পোশাকে আর এখানে কেতাদুরস্ত। আল্লার নামে বলছি, আমি জানতাম না আপনি আমার বড় সাহেব। কিভাবেই বা জানবো, আমার কি কখনো এখানে আসার সুযোগ হয়েছে?
বখতেয়ার ভাবছিলো পীর সাহেব নিরবে তাকে ভর্সনা করেছেন। তোমার মুখ বন্ধ করো বেকুব, সত্যিকারের মুসলমানেরা কখনো এতো বকবক করে না। তারা জানে কি ধরনের আচরণের অনুমোদন রয়েছে। গোপনীয়তার অর্থ তো প্রকাশিত নয়। পবিত্র কুরআনে তাই বলা হয়েছে...।
রাগে কাঁপতে থাকে বখতেয়ার। তার শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। মনে মনে সে বলে, বৃদ্ধ পীর, শোনো আমার কথা। এখানেও তুমি ধর্মের কথা টেনে আনলে? কিন্তু জানো তো-এখানে এটা কোনো কাজে আসবে না। অফিসের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসেও তুমি জানো না অন্য রুমে কী ঘটছে? যখন তুমি তোমার জ্ঞান নিয়ে মুখবাজি করো, তুমি কি জানো, এগুলো কিভাবে আমার কেইসটাকে মুগুরপেটা করে? এবার সে টেবিলের এক কোণে দাঁড়িয়ে চিকার করতে থাকে। আপনার অতীত কর্মকাণ্ডের সব খবর আমার জানা আছে পীর সাহেব। ওইসব কথার একটাও যদি আমি জনসমক্ষে প্রকাশ করি, তাহলে আপনি মানুষের মুখ দেখাতে পারবেন না। আমি একবার মুখ খুললে সব খবর তখন বুনো আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়বে। মিথ্যা আর প্রতারণা শুধু ব্যবসাতেই চলে, এ কথাটা আমার চেয়ে আপনারই বেশি জানার কথা। কিন্তু আপনি না জানার ভান করেছেন, সাধু সাজছেন। বলতে বলতে হঠা বখতেয়ারের গলা শুকিয়ে গিয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সে দেখছে, সামনের দামি চেয়ারটায় বসা লোকটা তার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। কৌতূহলে দুচোখ তার চক্চক করছে। বখতেয়ার এ চোখ দুটো চিনতে পারে। এতোসব বলার জন্য এখন তার তীব্র অনুতাপ হচ্ছে। আজ যা করেছে এমনটি সে সারাজীবন করেনি। এমন অপরাধের জন্য ঈশ্বর কি তাকে ক্ষমা করবেন? সামনে যিনি বসে আছেন তিনি না আবদুল করিম ভাট, না পীর সাহেব। তিনি তারই জন্মদাতা পিতা। তার পিতা-যিনি তাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে লালন করেছেন, তাকে পড়ালেখা শিখিয়েছেন এই চাকরিটা যোগাড় করে দিয়েছেন। গত পাঁচ বছরে তিনি তাকে একটা পরামর্শও দেননি। যিনি কিনা দুর্ঘটনার আগে প্রতিদিন সকাল-বিকাল তার কল্যাণের সংবাদ নিতেন।
বখতেয়ারের শরীর যেনো গলে যাচ্ছে, গলে গলে ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে একেবারে নিষ্পাপ শিশুর মতো। সে তার দুচোখ মুছে বসে পড়ে চেয়ারের পায়ার কাছে। পিতার পা বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, আব্বা আপনি আগে বলেননি কেনো আপনিই আমার উর্ধ্বতন কর্তা। এতো বছরেও জানতে দিলেন না, একটা ইঙ্গিত পর্যন্ত পাইনি। বুঝতে পারছি আপনি হয়তো গোপনীয়তা রক্ষার জন্যই এমনটি করেছেন। কিন্তু তাই বলে একটা পরামর্শও কি দিতে পারতেন না? আপনি কেনো আমাকে পথ দেখাননি? আপনি যদি ছোট্ট একটা নোট দিতেন তাহলেই কতো আগে আমার কেইসটা মিটে যেতো। আপনি কেনো তা করেননি, কেনো এতো পাষাণহৃদয় হলেন? সে মেঝেতে ঢলে পড়ে হেঁচকি তুলতে থাকে। এক পর্যায়ে শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করে। বড় সাহেব তাকে কোলে করে ওপরে উঠালেন। তার চোখের পানি মুছে দিলেন। মৃদুভাবে নাকে মুখে চোখে মাথ গজ বের করে পাশে রাখলেন। এবং খোলাবস্থাতেই ফাইলটিকে টেবিলের ওপর রেখে দুহাতে বখতেয়ারকে কপির ওপর শুইয়ে দিলেন। পাশে রাখা কাগজগুলো তার বুকের ওপর রেখে ফিতায় শক্ত একটি গিঁড়ো দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। এরপর যথারীতি ফাইলটি ট্রেতে রেখে দিলেন।

[ লেখক পরিচিতি: চমন লাল হাক্কু (Cahman lal Hakhoo) কাশ্মিরি ছোটগল্পকার। জন্ম ১৯৩৮ সালে। ছোট গল্পের পাশাপাশি তিনি নাটক রচনা করেন এবং বিশ্বসাহিত্য থেকে অনুবাদ করেন। যুদ্ধ তাঁর একটি অসাধারণ গল্প, বিশেষ করে এর বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলীর জন্য। যুদ্ধ (The War) বলতে আমরা আসলে যা বুঝি এ গল্পে তেমন কিছু নেই, রয়েছে অন্যরকম এক যুদ্ধের কথা। গল্পটির ইংরেজি অনুবাদক নিরজা মটো (Neerja Matto)। উল্লেখ্য যে, নিরজা মটো নিজেও একজন স্বনামধন্য লেখক এবং অনুবাদক। তিনি ইংরেজি ভাষায় লেখেন এবং কাশ্মিরি সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেন। (ছাপা হয়-শৈলীতে)]

বিঃ দ্রঃ
সবার প্রতি আহ্বান: আমার লেখাগুলো পড়ুন, মন্তব্য লিখুন এবং আপনার ছবিসহ সেন্ড করুন আমার ইমেইল ঠিকানায়। আমি ফেসবুকে পোস্ট করে দেব আপনার ছবিসহ। গাজী সাইফুল ইসলাম, অগত্যা তৃতীয় তলা, কাঁচিঝুলির মোড়, ময়মনসিংহ-২২০০।
E-mail: gazisaiful@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই :