গাজী সাইফুল ইসলাম
হানিফ কোরেশি পাকিস্তানি বংশোদ্ভব ব্রিটিশ লেখক। কেউ কেউ তাকে দার্শনিকও বলে থাকেন। মি. কোরেশি জন্মগ্রহণ করেন ৫ ডিসেম্বর ১৯৫৪, ইংল্যান্ডের ব্রোমলিতে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম দেশ ব্রিটেনে বড় হয়েও মি. কোরেশি সামপ্রদায়িক এবং সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত সম্পর্কে অর্জন করেছেন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিপুল অভিজ্ঞতা, যা তাঁর অধিকাংশ লেখার মূর্ত হয়ে ওঠেছে। পাকিস্তানি ইমিগ্রেন্ট পিতা এবং বৃটিশ মায়ের সন্তান মি. কোরেশি নিজের জীবনের জটিল বাস্তবতার জন্য নিজেকে আখ্যায়িত করেন একজন শংকর মানুষ হিসেবে। তিনি তাঁর বাল্যকাল থেকেই লেখক হতে চেয়েছেন। এবং উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন। টিনএজ বয়সকাল অতিক্রম করার আগেই প্রথম উপন্যাস লিখে শেষ করেন এবং তা ছাপার জন্য মনোনিত হয়।
মি. কোরেশি দর্শনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছেন কিংস কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করেই তিনি লিখে ফেলেন একটি পর্নগ্রাফি। কিন্তু তাতে আত্মতৃপ্তির চেয়ে আত্মঅসন্তুষ্টিই ঘটল বেশি। ফলে উপন্যাস লেখায় সাময়িক বিরতি দিয়ে লন্ডন রয়েল থিয়েটারের জন্য নাটক লিখতে শুরু করেন। নাটক রচনা করতে গিয়ে রয়েল থিয়েটারের সঙ্গে লেগে থাকলেন কিছুদিন। নাট্যকার হওয়ার পথে রয়েল থিয়েটার তাঁকে এগিয়ে দিলো অনেকটা দূর পর্যন্ত। এরপর ১৯৭৬ সালে লন্ডন থিয়েটারে তাঁর প্রথম সফল নাটক সোকিং আপ দি হিট-মঞ্চস্থ হয়। আর দ্বিতীয় নাটক 'দি মাদার কান্ট্রি'র জন্য ১৯৮০ সালে তিনি স্যামস টেলিভিশন প্লে-রাইট অ্যাওয়ার্ড পান। লন্ডনের অভিবাসীদের জীবন জটিলতা নিয়ে রচিত বোর্ডারলাইন নাটকটির জন্য আশাতীত সাফল্যের মুখ দেখেন তিনি। নাটকটি মঞ্চস্থ হয় রয়েল কোর্ট থিয়েটারে। এই সফলতা তাঁকে লন্ডন রয়েল শেকসপীয়ার কোম্পানির জন্য নাটক লেখার সুযোগ এনে দেয়। এরপরই তিনি লিখেন, আউটস্কারটস।
সিনেমা করার উদ্যোগ নিয়ে প্রথমবারে সফল হতে পারেন নি মি. কোরেশি। তবে প্রথম সিনেমা তাঁকে অনেক দর্শকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। বিশেষ করে, আমেরিকান দর্শকদের সঙ্গে। ১৯৮৫ সালে তিনি লিখেন তাঁর প্রথম চিত্রনাট্য মাই বিউটিফুল লুনড্রেট। এতে এক পাকিস্তানি অভিবাসী যুবকের গল্প বলা হয়েছে যে কি-না তার শ্বেতাঙ্গ বান্ধবীর সহযোগিতায় ওখানে একটি লুনড্রমেট খোলে। তাঁর এই চিত্রনাট্যটি প্রচুর সমালোচিত এবং প্রশংসিত দুই-ই হয়। একজন সমালোচক আটলানিন্টক-এ নাটকটির ভূয়সী প্রশংসা করলেন। কিন্তু বিরূপ সমালোচনা বেশি আসে পাকিন্তানিদের কাছ থেকে। দেশটির বিভিন্ন সংগঠন দাবী করে যে, কোরেশি তাঁর লেখার মাধ্যমে পাকিস্তানিদেরকে হেয় করেছেন। পাকিস্তানি বংশোদ্ভব একটি চরিত্রের চিত্রণের দ্বারা মি. কোরেশি তাদের হোমোসেক্সুয়েল আর ড্রাগ ডিলার হিসেবে তুলে ধরেছেন। এর দ্বারা তিনি সমগ্র পাকিস্তানি কমিউনিটিকে কলঙ্কিত করেছেন। এ ধরনের চরিত্রের জন্য আমেরিকান এবং বৃটিশ দর্শকদের কাছে পাকিস্তানীদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা বাড়বে। কোরেশি অবশ্য এ ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
হানিফ কোরেশি ১৯৯০ সালে রচিত তাঁর বেশ্যালয়ের বুদ্ধ উপন্যাসের জন্য হুইটব্রেড নভেল অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন। তাঁর সর্বশেষ বই দি বডি। একটি গল্পগ্রন্থ। এ বইয়ের দি বডি গল্পটি বেশ বড় গল্প, প্রায় উপন্যাসের মতো। পশ্চিমে তাঁর এ বইটি বেশ আলোচিত, কারণ তিনি গল্পটিতে জটিল বিষয়ের সঙ্গে গভীর দর্শন তুলে ধরেছেন। এ জন্য অনেকেই বলছেন, দার্শনিক হানিফ কোরেশিকে এ গল্পে পাওয়া যায়। একটি ভারতীয় সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে দি বডি বইটির আলোচনা করতে গিয়ে তারা সিহগাল লিখেছেন, দি বডি একটি এপিক ধারার রচনা, যা আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে একটি বিষ্ময়ের জগতে। তবে এর সহজবোধ্য ভাষার মধ্যে ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠে গভীর দর্শনের ছেঁড়া মেঘ, যেমনটি দেখা গেছে হ্যামলেট, ইকারাস ও ফাউস্ট-এ।
দি গার্ডিয়ান-এর এমা ব্রুকসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মি. কোরেশি বলেছিলেন, ''যখন লিখবেন সংঘাত খুঁজে নেবেন।''
অতিশয় পাশবিক সেক্স থেকে বেদনাদায়ক ছাড়াছাড়ি, জাতিগত অসহিষ্ণুতা, সামপ্রদায়িক বিদ্বেষ-এমন সব কঠিন বিষয়কে হানিফ কোরেশি উপজীব্য করেন তাঁর লেখায়। এটা শুধু তাঁর গল্প-উপন্যাসে নয় তাঁর সিনেমাতেও দেখা যায়। হানিফ কোরেশি যেন সবসময়ই জানেন-প্রগতিপন্থী যুবক-যুবতীরাই হবে তাঁর পাঠক। তিনি দেখেছেন, টিউবে চড়ে কর্মক্ষেত্রে যেতে যেতেও তারা তাঁর বেশ্যাপল্লীর বৌদ্ধ উপন্যাসটি পড়ছে। উদ্যাম যৌনতা, ড্রাগ আর ৭০ দশকের দক্ষিণ লন্ডনের জীবনবাস্তবতা তাঁর এ উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে। কোরেশির বর্তমান বয়স ৫৫, ধীরগতিতে হলেও চেহারায় এখন বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। তিনি তাঁর দি মাদার চিত্রনাট্যে দেখিয়েছেন ৭০ বছরের একজন মহিলার কেমন যৌন আচরণ করে।
মি. কোরেশি বেড়ে উঠেছেন দক্ষিণ লল্ডনের ব্রোমলির পতিতালয়ে। একবার অবৈধভাবে গাড়ি চালানোর দায়ে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছিল। তারা তাকে থানায় নিয়ে গেল। একজন পুলিশ, তাঁর জাতিগত অতীত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু কোরেশীর উত্তর দেওয়ার আগেই পুলিশটি তাঁর আপদমস্তক নিরীক্ষণ করে আপন মনে বলল, ''ভূ-মধ্যসাগর এলাকার চেহারা।'' মি. কোরেশি তখন বললেন, ''আমার সম্পর্কে এ অভিমত যথার্থ নয়।'' পুলিশটি তখন বলল, ''এ অভিমত তোমার নয়, আমার।''
আমি তখন বললাম, ''এটা অভিমতের কোনো বিষয় নয়। এটা হলো বাস্তবতা।''
পুলিশটি এবার তার কাছে রাখা একটা কাগজে 'অব মেডিটারনিয়ান এপ্যায়ারেন্স' বাক্যাংশটির নিচে দাগ দিল। আমি আসলে সত্যি সত্যি দোষী ছিলাম। কারণ গাড়ি চালানোয় আমার ভুল হয়েছিল। কিন্তু ওটা স্বীকার করার পরও, বেজন্মাটা কেমন একটা ভান করল জানেন? আমি যেই হই না কেন আমার সম্পর্কে সে যা ইচ্ছে লিখতে বা বলতে পারে। এবং তাই সে করল। এখন কল্পনা করুন, এ ধরনের একটা ঘটনা একজন মানুষের জন্য কতটা বিব্রতকর হতে পারে যখন তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়ে যান।
কোরেশির মা এখনও ব্রমলিতেই রয়েছেন। পিতা মারা গেছেন ক'বছর আগে। এখন তিনি এমন একটি বই লিখার কাজে ব্যস্ত যাতে তাঁর বাবার জার্নালগুলোর ওপর ব্যাপক আলোকপাত থাকবে। এ পাণ্ডুলিপিটিতে তাঁকে একটু অন্যরকম মনোযোগ ও আন্তরিকতা দিতে হচ্ছে। কারণ জার্নালগুলো পড়তে গিয়ে কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাঁকে। জার্নালগুলোর একটা অংশে তাঁর বাবার পতিতালয়ে প্রবেশের প্রথমদিনগুলোর কথা রয়েছে। তাঁর বাবার বয়স তখন ১৬। মি. কোরেশি মনে করছেন, ও বিষয়টার প্রতি তাঁর বেশি দৃষ্টি দেওয়া উচিত হবে না। কিন্তু তিনি এটাও ভাবছেন যে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে ওখানে তাঁর বাবার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়ে থাকতে পারে। তাঁকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওখানে আটকে রাখা হয়ে থাকতে পারে। তাঁর পাণ্ডুলিপি প্রায় শেষ পর্যায়ে। এমা ব্রুকস তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ''আপনার মা কি আপনার দি মাদার দেখেছেন?''
উত্তরে মি. কোরেশী বললেন, ''হ্যাঁ, তিনি ওটা পছন্দ করেছেন। কিন্তু তিনি এ প্রশ্নও করেছেন যে আমাকে আঘাত করার মতো কিছু কি রয়েছে এতে? আমার চোখ কি ঢেকে রাখতে হবে? অবশ্য তিনি স্বাভাবিকভাবেই তা দেখেছেন এবং ধরে নিয়েছেন যে, এটা সম্ভবত তাঁর সম্পর্কীত কিছু নয়।''
এমা বলেন, কোরেশির সঙ্গে আলাপ করতে এসে জানা গেল যে, সমপ্রতি একটা বিষয় তাঁকে বেশ আহত করেছে। তিনি হ্যাস্টিংসের একটি পাবে ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মত বিনিময় করছিলেন। তিনি জানালেন, বন্ধুদের একাংশের মনোভাবে তিনি বেশ বিরক্ত ও হতাশ হয়েছেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের নীতির সমালোচনা করে বললেন, যুদ্ধ এখন বিদ্যালয়ে থেকে ঘর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের কোনো নীতি নেই।Õ
মি. কোরেশির তিন ছেলে সিটি অব লন্ডন স্কুলের ছাত্র। দিয়ানে অ্যাবুটস-এর ছেলেও সেই একই স্কুলের ছাত্র। মি. কোরেশি বলেন, ‘তিনি তার সিদ্ধান্তের জন্য যখন আক্রান্ত হয়েছিলেন তখন কারও সহানুভূতি তিনি পান নি? তিনি চিৎকার করে বলেন, Ôনা, কোনো শালাই তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি। আমি তার দেখা পেলে জিজ্ঞেস করব - কেন তিনি একজন সাধারণ ব্যক্তির মতো সিদ্ধান্ত নিলেন? এটাতো তিনি পারেন না। এমন সিদ্ধান্তের জন্য আমি তার সমর্থন করি না। তিনি যে পার্টি করেন সেই পার্টি কেন কোনো স্কুল নির্মাণ করছে না? তিনি তো ওইসব কুলাঙ্গারদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন। তাহলেও কেন ওখানে একটা স্কুল নেই? কেন নোংরা রাজনীতির প্রভাব পড়বে স্কুল-কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর?Õ
কোরেশি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিংস কলেজে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বলেন, ''আমার বেশি আগ্রহ দার্শনিক মনোবিজ্ঞানের প্রতি আর নিটৎশে, ফ্রয়েড, ল্যাকন, ফুকাল্ট এবং দেরিদায়।'' তিনি বলেন, ''আমার মনে হয় ২০ শতাব্দির দার্শনিক বাস্তবতার মূল উপলব্ধি হলো ভাষা সম্পর্কে ইতিবাচক আন্ডারস্ট্যান্ডিং। ভাষা কী? কোথা থেকে ভাষা এসেছে? কীভাবে এটা কাজ করে? এবং কীভাবেই বা ভাষা অন্যের বোধগম্য হয়ে ওঠে? ভাষা ও লিঙ্গ ইত্যাদি...।''
খুব ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠে লিখতে বসেন। লিখেন আর ইন্টারনেট থেকে ডাউন লোড করেন। তিনি বলেন, Ôএ সব কাজ আমি দিনমান চালিয়ে যাই। সর্বদাই আমি লিখছি। আমি একজন ফুলটাইম লেখক। এর অর্থ এই নয় যে আমি একজন শৃঙ্খলা মেনে চলা লোক, আসলে নিজের কাজের প্রতি আমার একাগ্রতা অত্যন্ত বেশি।Õ
তাঁর সবচেয়ে মন্দার সময়টা সম্পর্কে তিনি বলেন, ''যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি, অপেক্ষা করছিলাম একজন সত্যিকারের লেখক প্রতিভার আবির্ভাব দেখার জন্য।'' অবশেষে নিজেই তিনি লন্ডন কোর্ট থিয়েটারের জন্য নাটক লিখতে শুরু করলেন। আর সে সময় তাঁর সৃষ্ট দি মাদার নাটকের একটা চরিত্র একজন অসফল লেখক। এমন একজন মহিলার চরিত্র তিনি চিত্রণ করলেন যার আকাঙ্ক্ষা তার যোগ্যতার সঙ্গে বেমানান। এ চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে নাটকের করুণ দৃশ্যও আনন্দঘন হয়ে ওঠেছে।
ধারণার মৃত্যু ঘটছে। ইদানিং এ কথাটা প্রায়শই শোনা যায়। কোরেশি এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন কি-না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: 'আমি তো এমনটি ঘটার কোনো কারণ দেখি না। আসলে যতটা বেশি সময় আপনি লেখার টেবিলে বসে ব্যয় করবেন ততটা আপনি জীবনকে দেখা থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন, আর আপনার লেখাতেও তাই জীবন ততটাই অনুপস্থিত থাকবে।' তিনি বলেন, ''কারো গরম ঘরটি ব্যবহার করতে চাইলে অবশ্যই আপনাকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। ঠিক বস্তুগত অন্যান্য সামগ্রি পেতে হলে যা যা করতে হয়।''
বিঃ দ্রঃ
সবার প্রতি আহ্বান: আমার লেখাগুলো পড়ুন, মন্তব্য লিখুন এবং সেন্ড করুন আমার ইমেইল ঠিকানায়। আমি আমার ব্লগে ও ফেসবুকে পোস্ট করে দেব মন্তব্যকারীর ছবিসহ। যারা ফেসবুকে কবিতা, গল্প উপন্যাস, বই রিভিউ, বইয়ে বিজ্ঞাপন, পাঠাতে চান-শর্তসাপেক্ষে পাঠাতে পারেন। ছাপা হাবে সংক্ষিপ্ত জীবনী ও ছবিসহ। আমার ঠিকানা : gazisaiful@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন