গ্রন্থ আলোচনা
তারুণ্যের জীবনমুখী অভিযাত্রা
রুবাইয়া জাহান
..................................................................
ঢাকার রাত।। গাজী সাইফুল ইসলাম
শব্দসমপ্রীতি প্রকাশন।। প্রথম প্রকাশ- ফেব্রুয়ারি ২০০৫
প্রচ্ছদ- ইলোরা বিশ্বাস
................................................................................
গাজী সাইফুল ইসলামের উপন্যাস ঢাকার রাত। নাম শুনে প্রথমে মনে হতে পারে যে, উপন্যাসটিতে ঢাকা শহরের রাতের চিরায়াত দৃশ্যের বর্ণনা করেছেন লেখক। কিন্তু তা তিনি করেন নি। সাংবাদিকতার কাজ এটা নয়। উপন্যাসটিতে লেখক এমন দুটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যারা আমাদের এ সমাজের অসংখ্য তরুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে।
এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দুটি, দুজন যুবক। নিমাই আর হেলাল। তারা দুটি ভিন্ন ধর্মের অনুসারী। চিন্তা-ভাবনার দিক থেকেও তাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। নিমাই বামপন্থী ভাবাদর্শের রাজনীতি থেকে বিচ্যুত, ছাত্রজীবন অসমাপ্ত থাকায় প্রাইভেট টিউশনিকে বেছে নিয়েছে জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে। এরপরও তার আদর্শ ও বিশ্বাসের মৃত্যু ঘটে নি। অপরজন হেলাল, খুবই সাধারণ একটি ছেলে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে অন্যের দয়ায়। তার মাঝেও শুভ-অশুভ চিন্তার অসংখ্য বুদ্বুদ ফেনায়িত হয়। আর্থিক দৈন্য তাদের এক ছাদের নিচে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দজনেই আংশিক হলেও বাস্তুচ্যুত, এই বিশ্বাস তাদের দুজনকে মনের দিক থেকে করে দিয়েছে আরও কাছাকাছি। ফলে তারা যত না ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে একে অপরের সুখ-দুঃখের ভাগীদার। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও অলিখিত অজ্ঞাত কমিটমেন্ট থেকে তারা একচুলও সরে যায় নি। যখন তাদের অশেষ দুঃখপূর্ণ সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আসে চরম আঘাত, যা তাদের সব স্বপ্ন ও সুন্দরের আয়োজনকে ভেঙে চূরমার করে দেয়।
গাজী সাইফুল ইসলামের এ উপন্যাসে সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উঠে এসেছে জোরালো বক্তব্য। সবধর্মের মানুষদের সহাবস্থানের মাধ্যমেই যে আমাদের পৃথিবী শান্তিপূর্ণ হতে পারে তাও আরেকটি প্রধান বক্তব্য এ উপন্যাসের। এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃতি দেয়া যায় হেলালের বক্তব্যের। দারুণ সত্য ও শক্ত কথা বলেছে সে। যেমন, প্রতিটি ধর্মের মধ্যে যে সহনশীলতার কথা বলা হয়েছে, কোনো ধর্মের অনুসারীরাই সে সহনশীলতার সিকিভাগও ফলো করে না। প্রত্যেকেই মনে করে তার ধর্ম এবং ধর্মের প্রচারক শ্রেষ্ঠ। আর ইসলাম ধর্মের যে কথাটা অন্য ধর্মের অনুসারীদের আতে ঘা দেয়, তাহলো, তারা মনে করে (তাদের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে) তাদের ধর্মের পূণ্যাত্মারাই কেবল বেহেশ্তে যাবে। অন্য সকল ধর্মের সবাই নরকের আগুনে পুড়বে। এমন কি সারাজীবন আরাধনা এবং মহৎ কাজ করেও তারা ঈশ্বরকে পাবে না। স্বর্গে আরোহণ করবে না।...ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো ধর্ম বিকৃত হতে পারে, সে ধর্মের অনুসারীরা পথভ্রষ্ট হতে পারে কিন্তু ওই ধর্মে যাদের বিশ্বাস তারা কি তা মেনে নেবে? তারা কি মেনে নেবে যে, একটি বিকৃত ধর্ম তারা অনুসরণ করছে? সভ্যতাসমূহের মাঝে যে সংকটের কথা বলেছেন স্যামুয়েল হান্টিংটন গাজী সাইফুল ইসলাম সে বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, শুধু সভ্যতাসমূহের মাঝে নয় মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাতও সৃষ্টি হয় একইরকম কারণে। কেবল স্বশিক্ষিত মানুষই পারে এমন সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে এবং পৃথিবীকে সব মানুষের বাসোপযোগী করে তুলতে। ঢাকার রাত উপন্যাসে হেলাল নিমাইকে একরাতে বলে শেষ করেছে তার অপ্রাপ্ত বয়সের প্রেমের কাহিনী। যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এক প্রেমের কাহিনী। অনভিজ্ঞ তারুণ্যের যৌন উচ্ছ্বাস সব বয়সের পাঠককেই আবেগদীপ্ত করবে। ক্ষেত্র বিশেষ কারো কাছে মনে হতে পারে কিছুটা বাড়াবাড়ি এতে করা হয়েছে কিন্তু বোদ্ধা পাঠকমাত্রই ঠিক বুঝতে পারবেন তা কখনোই শিল্পের সীমা অতিক্রম করে যায় নি। গন্ধম ফল খাওয়ার অপরাধে আদম-হাওয়া বেহেশ্ত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। আর হেলাল বহিষকৃত হলো আশ্রয়দাতার বাড়ি থেকে। কিন্তু তার কামজ প্রেম তার পিছু ছাড়ল না। প্রেমিকাসহ তাকে মিশিয়ে দিলো ধূলির সঙ্গে। ভয়ানক সে হত্যা দৃশ্য, প্রাণের দোস্ত হয়েও নিমাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখেছে। এরপর পালিয়েছে নিজের জীবন নিয়ে।
উপন্যাসটির পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতার ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া যায়। সবদিক বিবেচনা করে বলা যায়, ঢাকার রাত হতাশাগ্রস্থ তারুণ্যে সামনে একটি নতুন স্বপ্ন হয়ে চিরদিন তাদের সংগ্রামী হওয়ার পথে পরিচালিত করবে।
ঠিকানা:
রুবাইয়া জাহান
rubiyaj710@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন