পেরুর লেখিকা ইসাবেল আলেন্দের উপন্যাস
গ
পেরুরর লেখিকা ইসাবেল আলেন্দে বিশ্ব সাহিত্যের এক অসামন্য আইকন। (মতান্তরে তাঁর নামের উচ্চারণ আয়েন্দে॥ তাঁর শ্রেষ্ঠ তিনটি উপন্যাস হলো হাউস অব দি স্পিরিটিস (প্রথম উপন্যাস), মাই ইনভেন্টেড কান্ট্রি ও পাউলা। আলেন্দে লেখিকা হিসেবে বিশ্বখ্যাতি পান মাত্র এক বছরে। তাঁর উপন্যাস হাউজ অব দি স্পিরিটস(১৯৮২) একই সঙ্গে জার্মানি, চিলি, সুইটজারল্যান্ড এবং মেক্সিকোতে বুক অব দি ইয়ার হয়েছিল।
পাউলা উপন্যাসের নাম হলেও এটি আসলে তাঁর অসুস্থ মেয়ের নাম। বহুদিন সে কোমায় পড়েছিল। লেখিকা তাঁর মেয়ের জীবনের শেষদিনগুলোর কথা অত্যন্ত আবেগঘন ভাষায় পারবিারিক স্মৃকিথার আদলে তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসে। নিঃস্তেজ, অচেতন, বাকশক্তি রহিত কন্যার শয্যা পাশে বসে কন্যাকে উদ্দেশ্য করেই চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। প্রথমে এসব চিঠি শুধু চিঠিই ছিল। ইসাবেল আলেন্দে লিখেছেন: যখন তাকে উদ্দেশ্যে করে লিখতে শুরু করলাম আমার সামনে অতীতের সব স্মৃতি ভেসে আসতে লাগল। কোনো কিছুই আর কঠিন রইল না। মাস ছয়েক লেখার পর আমি বুঝতে পারলাম যে, মেয়েটি আমার আর সেরে উঠবে না। তবু আমি লিখে চললাম, কারণ আমি থামতে পারছিলাম না। হ্যাঁ, এক সময় যখন মনে হলো আর এগোতে পারছি না, তখন একইরকম চিঠি আমি লিখতে শুরু করলাম আমার মায়ের কাছে। পাউলার প্রাত্যাহিক জীবনের নানান বর্ণনা থাকতো ওসব চিঠিতে।”
আলেন্দে জন্ম গ্রহণ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪২ সালে), পেরুর লিমায়। তাঁর বাবা তখন চিলির দূতাবাসে চাকরি করতেন। ১৯৪৫ সালে যখন তাঁর বাবা ওখানকার কর্মস্থল থেকে ফেরার হলেন ইসাবেলের বয়স তখন মাত্র ৩ বছর। তাঁর পরিবারে কোনো ধারণা ছিল না তিনি কোথায় যেতে পারেন। ধারণা করা হয় তিনি ছিলেন একজন সমকামী, এবং সম্ভবত কোনো অঘটন ঘটিয়ে ওখান থেকে পালিয়েছিলেন। ইসাবেল ততদিন তাকে দেখতে পাননি, যতদিন না তার লাশ পাওয়া গেল রাস্তার ওপর। ইসাবেলকে বলা হয়েছিল তাঁর বাবার লাশ সনাক্ত করার জন্য। তাঁর মা পরে আবার একজন ডিপ্লোমেটকে বিয়ে করেন। এবং এরপর তাদের পরিবার চলে গেল ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে তিনি যেখানে চাকরি করতেন।
একজন কূটনীতিকের সন্তান হিসেবে যৌবনের শুরুতে আলেন্দে যাপন করেছেন এক ধরনের ভবঘুরে জীবন। কিন্তু খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, কারও মূলই তার ভূমিতে প্রোথিত থাকে না, কিংবা থাকে না তার দেশে, কিংবা যে মানুষদের সঙ্গে সে বসবাস করে তাদের মধ্যে। তার মূল থাকে তার নিজেরই ভেতরে।
ইসাবেল আলেন্দে তাঁর জীবন শুরু করেছেন সাংবাদিকতা দিয়ে। ওই পেশা তাঁকে কীভাবে চরিত্র নির্মাণ করতে হয় ও গল্প দাঁড় করাতে হয় সেটা শিক্ষা দিয়েছিল। যা পরবর্তী সময়ে উপন্যাসের জগতে তাঁকে পা রাখতে সাহায্য করেছে। কিন্তু নিরপেক্ষ সাংবাদিক তিনি ছিলেন না। সব সময় নিজের তৈরি গল্প ছেড়ে দিতেন করা কভার স্টরিতে। তবে লেখক হওয়ার জন্য সাংবাদিকতায় তাঁর নিরপেক্ষ হওয়াটা জরুরি ছিল না। এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের লেখা প্রণিধানযোগ্য: আমি ছিলাম ইতর সাংবাদিক। আর আগে এ কথাটাকেই বলতেন অন্যভাবে: আমি কোনোদিনই একজন ভালো সাংবাদিক (নিরপেক্ষতার অর্থে) ছিলাম না। কোনো কিছুতেই বস্তুনিষ্ঠ হতে পারতাম না। মাঝেমধ্যে দেখা যেত আমার রিপোর্টের সবটা গল্পই বানানো। একবার যখন মহান কবি পাবলো নিরুদার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেছিলেন: এদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে তুমি সবচেয়ে খারাপ। সবসময় সাজিয়েগুজিয়ে মিথ্যে কথা লিখ। তাহলে সাহিত্য করার চেষ্টা করছ না কেন?
পাউলা উপন্যাস সম্পর্কে আমরা লেখিকার লেখা থেকেই জানতে পারি সবচেয়ে বেশি। যেমন তিনি লিখেছেন:
“মা পাউলার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য এসেছিলেন। ওই সময় তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন পাউলাকে নিয়ে তাঁর কাছে লিখা আমার সব চিঠি। সব মিলিয়ে ১৯০টি। চিঠিগুলো পড়ে আমার তখন মনে হলো, পাউলাকে নিয়েই সবচেয়ে ভালো কিছু হতে পারে। মরে গিয়ে সে আমাকে এমন কিছু দিয়ে গেছে যার তুলনা নেই। বহুদিন ধরে তার অবস্থান ছিল জীবন আর মৃত্যু, পৃথিবী আর স্বর্গের মাঝামাঝি।
পরে যখন মাকে এবং পাউলার উদ্দেশ্যে লিখা চিঠিগুলো একত্র করে তারিখ মিলিয়ে আবার পড়লাম, মনে হলো একটি বইয়ের মধ্যে স্থান দিলেই এগুলোর জন্য উত্তম একটা জায়গা হয়। প্রথমে মনে করেছিলাম একটা বইয়ের আকারে চিঠিগুলো সাজিয়ে রাখব, এমন বিষয় নিয়ে বই প্রকাশ করব না। নাম-ধাম-সময় সবই তো বাস্তব। মনে করলাম পারিবারিক স্মৃতি হিসেবে রেখে দেব। যখন লিখা শেষ হয়ে গেল, পড়তে দিলাম নিজের ছেলের মতো পাউলার স্বামীকে| বই করার চিন্তা মাথায় এলো। যারা এর চরিত্র তাদের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠালাম, তারা আপত্তি জানাল না।
আমি সবসময় মনে করতাম, তার মরে যাওয়ার পর আমি হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলব। বেঁচে থাকলে আত্মহত্যা করবো। অথবা জীবন সম্পর্কে আমার বোধ হারিয়ে ফেলব। এ অবস্থায় ঘুমোতে পারতাম না বলে প্রতিদিন বালিশের নিচে ঘুমের বড়ি লুকিয়ে রাখতাম। যখন সে মারা গেল, আমার মনে হলো যা কিছু ঘটেছে লিখে রাখা দরকার। এবং এক বছর ধরে আমি তাকে নিয়ে আমার স্মৃতিগুলো লিখে চললাম। এভাবে লেখাই আমাকে বাঁচিয়ে দিলো। এটা কোনো দুঃখের বই নয়। বরং দুঃখ জয়ের বই।
পাউলা লিখা কঠিন ছিল না, বরং ছিল আরোগ্যকর। এটা লিখতে লিখতে আমার চোখে জল ঝরেছে কিন্তু লিখেছি একদমে। গুরুত্বপূর্ণ শব্দ যেগুলো জানা ছিল না পাউলা নিজেই যেন সেগুলো আমাকে বলে দিয়েছে। আমার তার মৃত্যুর এক মাস পর আমি বইটি লিখতে শুরু করেছিলাম। এবং এক বছর ধরে লিখেছিলাম। ওই সময়টা আমি স্থায়ীভাবে পাউলার সঙ্গ লাভ করেছি। মনে করতে চেষ্টা করেছি এবং বিশ্লেষণ করেছি যা কিছু ঘটেছে। হারানোর মাঝে পাওয়ার আনন্দ খুঁজেছি। ট্রাজেডি কী এই বইটি আমাকে বুঝিয়েছে। এর মাধ্যমে আমি আমার পুরো জীবনের দিকে একবার ফিরে তাকানোর সুযোগ পেয়েছি।
যদিও পাউলা আলেন্দের সেরা উপন্যাস, যদিও এটি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পাঠকদের অশ্রুভারাক্রান্ত করে, তথাপি এ উপন্যাস সম্পর্কে রয়েছে অনেক সমালোচনা ও মন্তব্য। ভিক্টোরিয়া পারেরা বলেছেন, ঔপন্যাসক ইসাবেল আলেন্দে পাউলা উপন্যাসের মাধ্যমে নিজের কন্যার আধুনিক কষ্টের পুরনো অর্থ খুঁজে বেরিয়েছেন। এটা স্রেফ একটা পারবিারিক স্মৃতিকথা। এর প্রমাণ উপন্যাসটির বহু স্থানে রয়েছে। যেমন আমি ঈশ্বরকে খুঁজেছি কিন্তু মনে হয় তিনি আমার সঙ্গে ছলনা করেছেন। অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন মাত্র আগে ঠিক এ কথাই পাউলা এক চিঠিতে লিখেছিল তাঁর মাকে। এরপরই সে অসুস্থ ও প্যরালাইজড হয়ে জমে যায় এবং ক্রমশ কোমাবস্থা লাভ করে। পিতার কাছ থেকে বংশগত ধারায় পাওয়া এ রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকদের কমই জানা ছিল। এবং ওটা ছিল নিরাময়ের অযোগ্য।
আলেন্দে তাঁর চিঠি শুরু করেছিলেন, মাদ্রিদ হাসপাতালে কন্যার রোগশয্যার পাশে বসে। কোমাবস্থায় নিপতিত কন্যাকে বাঁচিয়ে তোলার ব্যাপারটা যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ছিল- ততই নিজের মায়ের কথা তাঁর মনে পড়ছিল। এজন্য তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, মায়ের ভালোবাসা ও দাবী উপেক্ষা করে মেয়ে ক্রমশই আরেক জগতের দিকে পা দিয়েছে।
কাকতালীয়ভাবে পাউলার অসুস্থ হওয়ার আগের সময়টায় আলেন্দে মা ব্যস্ত ছিলেন একান্তই তাঁর নিজের জীবন এবং লেখালেখি নিয়ে। সেদিনও তিনি তাঁর উপন্যাস দি ইনফাইনাট প্লেন-এর বিক্রি বাড়ানোর জন্য মাদ্রিদে প্রচারণার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কেমন যেন রূপগল্প কিংবা গ্রীক ট্রাজেডির মতো মনে হয়। মাকে ডেকে আনা হলো মারাত্মক অসুস্থ কন্যার পাশে। কিন্তু তিনি কন্যার রোগমুক্তির পথে কোনো আশার আলোই দেখতে পাচ্ছিলেন না। পাউলা অসুস্থ হলো ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে, তখন তা বয়স ২৬। আর ওটা ছিল তার বিয়ে বছর, আর্নেস্তোকে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। তাদের দুজনের মাঝে প্রেমও ছিল গভীর।
মিয়ামি হেরাল্ড-এর মারগারিয়া ফিক্চনার পাউলা প্রসঙ্গে লিখেছেন, যদিও বইটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় হতাশা ও বেদনার বুদ্ব বুদ্ব উপচে পড়ে, কিন্তু এর ভাষা ও বর্ণনার যাদুময়তা আলেন্দের প্রথম উপন্যাস হাউজ অব দি স্পিরিট-এর মতোই পাঠকদের বিস্মিত করে। এ উপন্যাস শুধু আলেন্দের কন্যার মৃত্যু জনিত আহাজারিই প্রকাশ করে না - এর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় যুক্ত হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতি আর চিলির ইতিহাস।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩, প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে তাঁর পিতার চাচাত (বা মামাত) ভাই, চিলির প্রথম কমিউনিস্ট নেতা, সামরিক অভ্যুত্থানে মৃত্যুবরণ করেন। ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল পিনোশে। ইসাবেল তখন একজন সাংবাদিক। ফলে প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েন তিনি। তিনি লিখেন, দেশ ছাড়ার জন্য আমাদের ২৪ ঘণ্টা সময় বেধে দেয়া হলো। শুরু হলো জীবন বদলে যাওয়ার পালা। ইসাবেল ব্যাখ্যা করেন, তিনি তখন তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ভেনিজুয়েলায় পাড়ি জমান। তিনি কখনোই ভাবেন নি যে, তাঁর নির্বাসনটা হবে চিরকালের জন্য। এরপর চিলিতে মিলিট্যারি শাসন চলল ১৭ বছর ধরে।। ইসাবেল আলেন্দে মনে করেন, পাউলা লিখতে গিয়ে নিজের জীবনকে প্রশ্ন করার সুযোগ তিনি পেয়েছেন, এতে তিনি তাঁর জীবনের অন্ধকার দিকের সোজাসাপ্টা বর্ণনা করেছেন। এতে ব্যক্তি আলেন্দের জীবনের সীমাদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন লেখিকা আলেন্দে। জীবন ঘনিষ্ঠ বর্ণনার কারণে গল্পটি এমন এক বোধের স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে যে, এটাকে বলা যায় গ্রীক ট্রাজেডির নবায়ন। ফরাসি দার্শনিক সিমন উইলি তাঁর প্রবন্ধ, দি লাভ অব গড এন্ড অ্যাফ্লিকশন-এ দেখিয়েছেন, শারীরিক-মানসিক কষ্ট যারা নিপতিত হন, তাদের বেশিরভাগ মানুষ দ্রুত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যান। জীবনের সব ধরনের স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্যুৎ হয়ে পড়লে যে কঠোর দুর্দশা মানুষের জীবনে আসে, তার মুখোমুখি করতে গেলে অনেক সময়ই মানুষ মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আর ওই মানসিক অবস্থা থেকে শারীরিক কঠিন সমস্যারও সৃষ্টি হয়। দুর্দশা জীবনকে সকল দিক থেকে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে আক্রমণ করে থাকে।
দার্শনিক উইলির মতে, পাউলা দুর্দশাগ্রস্থ ছিল না। কারণ তার শরীরে কোনো বেদনা সে কোনো বেদনা অনুভব করতো না। মাদ্রিদের চিকিৎসকগণও এই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। ইসাবেল আলেন্দের বিশ্বাসও একরকম ছিল যে, চেতন অবস্থাতেও পাউলা তার কাছে কোনো প্রকার শারীরিক বেদনার কথা বলেনি। যদিও নিঃসার হয়ে যাওয়া তার শরীরিক কারণেই তার মন বা চেতনা শক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল
তাঁর প্রথম উপন্যাস হাউজ অব দি স্পিরিটস (১৯৮২), শুরু করেছিলেন দাদার (বা নানার) কাছে একটা চিঠি দিয়ে। যাতে তিনি তাঁর বাল্যের সব স্মৃতি তুলে ধরেছিলেন একনিষ্ঠ আন্তরিকতায়। পরে ১৯৯৯ সালে লিখেন পাউলা, অসুস্থ্য মৃত্যু পথযাত্রী তাঁর মেয়ের শয্যাপাশে বসে। মেয়ে পাউলার মৃত্যু পর থেকে তিনি লেখাকে নিয়েছেন বেঁচে থাকার থেরাপি হিসেবে।
মিসেস আলেন্দের আয়ত্ব করা ইংরেজি অত্যন্ত উঁচু মানের। বলতে এবং লিখতেও পারেন ফ্লুয়েন্টলি। তবু মাতৃভাষার প্রতি তাঁর দুর্বলতা রয়ে গেছে আগেরই মতো। একবার তিনি বলেছিলেন: স্পেনিশ ভাষায় গল্প লিখে এখনও আমি বেশি মজা পাই।
দৈনিক যুগান্তর সাময়িকী
২৩ মার্চ ২০০৭।
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন