মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০১১

Book Review: Paula - A Novel by Isabel Alende

পেরুর লেখিকা ইসাবেল আলেন্দের উপন্যাস

পেরুরর লেখিকা ইসাবেল আলেন্দে বিশ্ব সাহিত্যের এক অসামন্য আইকন। (মতান্তরে তাঁর নামের উচ্চারণ আয়েন্দেতাঁর শ্রেষ্ঠ তিনটি উপন্যাস হলো হাউস অব দি স্পিরিটিস (প্রথম উপন্যাস), মাই ইনভেন্টেড কান্ট্রি পাউলা আলেন্দে লেখিকা হিসেবে বিশ্বখ্যাতি পান মাত্র এক বছরেতাঁর উপন্যাস হাউজ অব দি স্পিরিটস(১৯৮২) একই সঙ্গে জার্মানি, চিলি, সুইটজারল্যান্ড এবং মেক্সিকোতে বুক অব দি ইয়ার হয়েছিল
পাউলা উপন্যাসের নাম হলেও এটি আসলে তাঁর অসুস্থ মেয়ের নামবহুদিন সে কোমায় পড়েছিললেখিকা তাঁর মেয়ের জীবনের শেষদিনগুলোর কথা অত্যন্ত আবেগঘন ভাষায় পারবিারিক স্মৃকিথার আদলে তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসেনিঃস্তেজ, অচেতন, বাকশক্তি রহিত কন্যার শয্যা পাশে বসে কন্যাকে উদ্দেশ্য করেই চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন তিনিপ্রথমে এসব চিঠি শুধু চিঠিই ছিলইসাবেল আলেন্দে লিখেছেন: যখন তাকে উদ্দেশ্যে করে লিখতে শুরু করলাম আমার সামনে অতীতের সব স্মৃতি ভেসে আসতে লাগলকোনো কিছুই আর কঠিন রইল নামাস ছয়েক লেখার পর আমি বুঝতে পারলাম যে, মেয়েটি আমার আর সেরে উঠবে নাতবু আমি লিখে চললাম, কারণ আমি থামতে পারছিলাম নাহ্যাঁ, এক সময় যখন মনে হলো আর এগোতে পারছি না, তখন একইরকম চিঠি আমি লিখতে শুরু করলাম আমার মায়ের কাছেপাউলার প্রাত্যাহিক জীবনের নানান বর্ণনা থাকতো ওসব চিঠিতে
আলেন্দে জন্ম গ্রহণ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪২ সালে), পেরুর লিমায়তাঁর বাবা তখন চিলির দূতাবাসে চাকরি করতেন১৯৪৫ সালে যখন তাঁর বাবা ওখানকার কর্মস্থল থেকে ফেরার হলেন ইসাবেলের বয়স তখন মাত্র ৩ বছরতাঁর পরিবারে কোনো ধারণা ছিল না তিনি কোথায় যেতে পারেনধারণা করা হয় তিনি ছিলেন একজন সমকামী, এবং সম্ভবত কোনো অঘটন ঘটিয়ে ওখান থেকে পালিয়েছিলেনইসাবেল ততদিন তাকে দেখতে পাননি, যতদিন না তার লাশ পাওয়া গেল রাস্তার ওপরইসাবেলকে বলা হয়েছিল তাঁর বাবার লাশ সনাক্ত করার জন্যতাঁর মা পরে আবার একজন ডিপ্লোমেটকে বিয়ে করেনএবং এরপর তাদের পরিবার চলে গেল ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে তিনি যেখানে চাকরি করতেন
একজন কূটনীতিকের সন্তান হিসেবে যৌবনের শুরুতে আলেন্দে যাপন করেছেন এক ধরনের ভবঘুরে জীবনকিন্তু খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, কারও মূলই তার ভূমিতে প্রোথিত থাকে না, কিংবা থাকে না তার দেশে, কিংবা যে মানুষদের সঙ্গে সে বসবাস করে তাদের মধ্যেতার মূল থাকে তার নিজেরই ভেতরে
ইসাবেল আলেন্দে তাঁর জীবন শুরু করেছেন সাংবাদিকতা দিয়েওই পেশা তাঁকে কীভাবে চরিত্র নির্মাণ করতে হয় ও গল্প দাঁড় করাতে হয় সেটা শিক্ষা দিয়েছিলযা পরবর্তী সময়ে উপন্যাসের জগতে তাঁকে পা রাখতে সাহায্য করেছেকিন্তু নিরপেক্ষ সাংবাদিক তিনি ছিলেন নাসব সময় নিজের তৈরি গল্প ছেড়ে দিতেন করা কভার স্টরিতেতবে লেখক হওয়ার জন্য সাংবাদিকতায় তাঁর নিরপেক্ষ হওয়াটা জরুরি ছিল নাএ প্রসঙ্গে তাঁর নিজের লেখা প্রণিধানযোগ্য: আমি ছিলাম ইতর সাংবাদিক আর আগে এ কথাটাকেই বলতেন অন্যভাবে: আমি কোনোদিনই একজন ভালো সাংবাদিক (নিরপেক্ষতার অর্থে) ছিলাম নাকোনো কিছুতেই বস্তুনিষ্ঠ হতে পারতাম নামাঝেমধ্যে দেখা যেত আমার রিপোর্টের সবটা গল্পই বানানোএকবার যখন মহান কবি পাবলো নিরুদার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেছিলেন: এদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে তুমি সবচেয়ে খারাপসবসময় সাজিয়েগুজিয়ে মিথ্যে কথা লিখতাহলে সাহিত্য করার চেষ্টা করছ না কেন?
পাউলা উপন্যাস সম্পর্কে আমরা লেখিকার লেখা থেকেই জানতে পারি সবচেয়ে বেশিযেমন তিনি লিখেছেন:
মা পাউলার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য এসেছিলেনওই সময় তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন পাউলাকে নিয়ে তাঁর কাছে লিখা আমার সব চিঠিসব মিলিয়ে ১৯০টিচিঠিগুলো পড়ে আমার তখন মনে হলো, পাউলাকে নিয়েই সবচেয়ে ভালো কিছু হতে পারেমরে গিয়ে সে আমাকে এমন কিছু দিয়ে গেছে যার তুলনা নেইবহুদিন ধরে তার অবস্থান ছিল জীবন আর মৃত্যু, পৃথিবী আর স্বর্গের মাঝামাঝি
পরে যখন মাকে এবং পাউলার উদ্দেশ্যে লিখা চিঠিগুলো একত্র করে তারিখ মিলিয়ে আবার পড়লাম, মনে হলো একটি বইয়ের মধ্যে স্থান দিলেই এগুলোর জন্য উত্তম একটা জায়গা হয়প্রথমে মনে করেছিলাম একটা বইয়ের আকারে চিঠিগুলো সাজিয়ে রাখব, এমন বিষয় নিয়ে বই প্রকাশ করব নানাম-ধাম-সময় সবই তো বাস্তবমনে করলাম পারিবারিক স্মৃতি হিসেবে রেখে দেবযখন লিখা শেষ হয়ে গেল, পড়তে দিলাম নিজের ছেলের মতো পাউলার স্বামীকে| বই করার চিন্তা মাথায় এলোযারা এর চরিত্র তাদের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠালাম, তারা আপত্তি জানাল না
আমি সবসময় মনে করতাম, তার মরে যাওয়ার পর আমি হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলববেঁচে থাকলে আত্মহত্যা করবোঅথবা জীবন সম্পর্কে আমার বোধ হারিয়ে ফেলবএ অবস্থায় ঘুমোতে পারতাম না বলে প্রতিদিন বালিশের নিচে ঘুমের বড়ি লুকিয়ে রাখতামযখন সে মারা গেল, আমার মনে হলো যা কিছু ঘটেছে লিখে রাখা দরকারএবং এক বছর ধরে আমি তাকে নিয়ে আমার স্মৃতিগুলো লিখে চললামএভাবে লেখাই আমাকে বাঁচিয়ে দিলোএটা কোনো দুঃখের বই নয়বরং দুঃখ জয়ের বই
পাউলা লিখা কঠিন ছিল না, বরং ছিল আরোগ্যকরএটা লিখতে লিখতে আমার চোখে জল ঝরেছে কিন্তু লিখেছি একদমে  গুরুত্বপূর্ণ শব্দ যেগুলো জানা ছিল না পাউলা নিজেই যেন সেগুলো আমাকে বলে দিয়েছেআমার তার মৃত্যুর এক মাস পর আমি বইটি লিখতে শুরু করেছিলামএবং এক বছর ধরে  লিখেছিলামওই সময়টা আমি স্থায়ীভাবে পাউলার সঙ্গ লাভ করেছিমনে করতে চেষ্টা করেছি এবং বিশ্লেষণ করেছি যা কিছু ঘটেছেহারানোর মাঝে পাওয়ার আনন্দ খুঁজেছিট্রাজেডি কী এই বইটি আমাকে বুঝিয়েছেএর মাধ্যমে আমি আমার পুরো জীবনের দিকে একবার ফিরে তাকানোর সুযোগ পেয়েছি
যদিও পাউলা আলেন্দের সেরা উপন্যাস, যদিও এটি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পাঠকদের অশ্রুভারাক্রান্ত করে, তথাপি এ উপন্যাস সম্পর্কে রয়েছে অনেক সমালোচনা ও মন্তব্যভিক্টোরিয়া পারেরা বলেছেন, ঔপন্যাসক ইসাবেল আলেন্দে পাউলা উপন্যাসের মাধ্যমে নিজের কন্যার আধুনিক কষ্টের পুরনো অর্থ খুঁজে বেরিয়েছেনএটা স্রেফ একটা পারবিারিক স্মৃতিকথাএর প্রমাণ উপন্যাসটির বহু স্থানে রয়েছেযেমন আমি ঈশ্বরকে খুঁজেছি কিন্তু মনে হয় তিনি আমার সঙ্গে ছলনা করেছেন অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন মাত্র আগে ঠিক এ কথাই পাউলা এক চিঠিতে লিখেছিল তাঁর মাকেএরপরই সে অসুস্থ ও প্যরালাইজড হয়ে জমে যায় এবং ক্রমশ কোমাবস্থা লাভ করেপিতার কাছ থেকে বংশগত ধারায় পাওয়া এ রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকদের কমই জানা ছিলএবং ওটা ছিল নিরাময়ের অযোগ্য
আলেন্দে তাঁর চিঠি শুরু করেছিলেন, মাদ্রিদ হাসপাতালে কন্যার রোগশয্যার পাশে বসেকোমাবস্থায় নিপতিত কন্যাকে বাঁচিয়ে তোলার ব্যাপারটা যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ছিল- ততই নিজের মায়ের কথা তাঁর মনে পড়ছিলএজন্য তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, মায়ের ভালোবাসা ও দাবী উপেক্ষা করে মেয়ে ক্রমশই আরেক জগতের দিকে পা দিয়েছে
কাকতালীয়ভাবে পাউলার অসুস্থ হওয়ার আগের সময়টায় আলেন্দে মা ব্যস্ত ছিলেন একান্তই তাঁর নিজের জীবন এবং লেখালেখি নিয়েসেদিনও তিনি তাঁর উপন্যাস দি ইনফাইনাট প্লেন-এর বিক্রি বাড়ানোর জন্য মাদ্রিদে প্রচারণার কাজে ব্যস্ত ছিলেনকেমন যেন রূপগল্প কিংবা গ্রীক ট্রাজেডির মতো মনে হয়মাকে ডেকে আনা হলো মারাত্মক অসুস্থ কন্যার পাশেকিন্তু তিনি কন্যার রোগমুক্তির পথে কোনো আশার আলোই দেখতে পাচ্ছিলেন নাপাউলা অসুস্থ হলো ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে, তখন তা বয়স ২৬আর ওটা ছিল তার বিয়ে বছর, আর্নেস্তোকে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলতাদের দুজনের মাঝে প্রেমও ছিল গভীর
মিয়ামি হেরাল্ড-এর মারগারিয়া ফিক্‌চনার পাউলা প্রসঙ্গে লিখেছেন, যদিও বইটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় হতাশা ও বেদনার বুদ্ব বুদ্ব উপচে পড়ে, কিন্তু এর  ভাষা ও বর্ণনার যাদুময়তা আলেন্দের প্রথম উপন্যাস হাউজ অব দি স্পিরিট-এর মতোই পাঠকদের বিস্মিত করেএ উপন্যাস শুধু আলেন্দের কন্যার মৃত্যু জনিত আহাজারিই প্রকাশ করে না - এর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় যুক্ত হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতি আর চিলির ইতিহাস
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩, প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে তাঁর পিতার চাচাত (বা মামাত) ভাই, চিলির প্রথম কমিউনিস্ট নেতা, সামরিক অভ্যুত্থানে মৃত্যুবরণ করেনক্ষমতা দখল করেন জেনারেল পিনোশেইসাবেল তখন একজন সাংবাদিকফলে প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েন তিনিতিনি লিখেন, দেশ ছাড়ার জন্য আমাদের ২৪ ঘণ্টা সময় বেধে দেয়া হলোশুরু হলো জীবন বদলে যাওয়ার পালা ইসাবেল ব্যাখ্যা করেন, তিনি তখন তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ভেনিজুয়েলায় পাড়ি জমানতিনি কখনোই ভাবেন নি  যে, তাঁর নির্বাসনটা হবে চিরকালের জন্যএরপর চিলিতে মিলিট্যারি শাসন চলল ১৭ বছর ধরে।। ইসাবেল আলেন্দে মনে করেন, পাউলা লিখতে গিয়ে নিজের জীবনকে প্রশ্ন করার সুযোগ তিনি পেয়েছেন, এতে তিনি তাঁর জীবনের অন্ধকার দিকের সোজাসাপ্টা বর্ণনা করেছেনএতে ব্যক্তি আলেন্দের জীবনের সীমাদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন লেখিকা আলেন্দেজীবন ঘনিষ্ঠ বর্ণনার কারণে গল্পটি এমন এক বোধের স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে যে, এটাকে বলা যায় গ্রীক ট্রাজেডির নবায়নফরাসি দার্শনিক সিমন উইলি তাঁর প্রবন্ধ, দি লাভ অব গড এন্ড অ্যাফ্লিকশন-এ দেখিয়েছেন, শারীরিক-মানসিক কষ্ট যারা নিপতিত হন, তাদের বেশিরভাগ মানুষ দ্রুত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যানজীবনের সব ধরনের স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্যুৎ হয়ে পড়লে যে কঠোর দুর্দশা মানুষের জীবনে আসে, তার মুখোমুখি করতে গেলে অনেক সময়ই মানুষ মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েআর ওই মানসিক অবস্থা থেকে শারীরিক কঠিন সমস্যারও সৃষ্টি হয়  দুর্দশা জীবনকে সকল দিক থেকে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে আক্রমণ করে থাকে
দার্শনিক উইলির মতে, পাউলা দুর্দশাগ্রস্থ ছিল নাকারণ তার শরীরে কোনো বেদনা সে কোনো বেদনা  অনুভব করতো নামাদ্রিদের চিকিৎসকগণও এই মনোভাব ব্যক্ত করেছেনইসাবেল আলেন্দের বিশ্বাসও একরকম ছিল যে, চেতন অবস্থাতেও পাউলা তার কাছে কোনো প্রকার শারীরিক বেদনার কথা বলেনিযদিও নিঃসার হয়ে যাওয়া তার শরীরিক কারণেই তার মন বা চেতনা শক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল
তাঁর প্রথম উপন্যাস হাউজ অব দি স্পিরিটস (১৯৮২), শুরু করেছিলেন দাদার (বা নানার) কাছে একটা চিঠি দিয়েযাতে তিনি তাঁর বাল্যের সব স্মৃতি তুলে ধরেছিলেন একনিষ্ঠ আন্তরিকতায়পরে ১৯৯৯ সালে লিখেন পাউলা, অসুস্থ্য মৃত্যু পথযাত্রী তাঁর মেয়ের শয্যাপাশে বসেমেয়ে পাউলার মৃত্যু পর থেকে তিনি লেখাকে নিয়েছেন বেঁচে থাকার থেরাপি হিসেবে
 মিসেস আলেন্দের আয়ত্ব করা ইংরেজি অত্যন্ত উঁচু মানেরবলতে এবং লিখতেও পারেন ফ্লুয়েন্টলিতবু মাতৃভাষার প্রতি তাঁর দুর্বলতা রয়ে গেছে আগেরই মতোএকবার তিনি বলেছিলেন: স্পেনিশ ভাষায় গল্প লিখে এখনও আমি বেশি মজা পাই


  দৈনিক যুগান্তর সাময়িকী
২৩ মার্চ ২০০৭

কোন মন্তব্য নেই :